সমস্ত পৃথিবীটাই সাবিরার কাছে নীরব-নিঝুম। ছোটবেলা থেকেই সাবিরা শুনতে পান না। বলতে পারেন না কথা। মেয়ের পড়ালেখা হবে কি না এই ভেবে মহা দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন মা-বাবা। সেই সাবিরাই শেষতক কীভাবে পৌঁছে গেলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ অক্সফোর্ড অবধি? বনে গেলেন অক্সফোর্ডের গবেষক?
মেয়েটির জন্ম হয়েছিল তার যখন জন্ম হওয়ার কথা, তার দুই মাস আগেই। ১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে। মা-বাবা দুজনই তাই অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত ছিলেন। জন্মের পর মা তাকিয়ে দেখেছিলেন সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তানটিকে। দেখলেন, ভারি সুন্দর। চিৎকার করে কাঁদছে। খুশি হলেন মা-বাবা দুজনই। তবে সন্তানটি বাঁচবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা করলেন নামকরা ডাক্তার, দেখাশোনা করছিলেন—এই যা ভরসা। কিন্তু সন্তানটি জন্ম নেওয়ার এক সপ্তাহ পরই তার জটিল সমস্যা দেখা দিল—নিউমোনিয়া হলো। তাকে বাঁচানো যাবে কি না, সেটাই আশঙ্কার কারণ হয়ে দেখা দিল। ডাক্তার তাকে একটি অ্যান্টিবায়োটিক দিলেন ইনজেকশনের মাধ্যমে। বহু চিকিৎসা আর পরিচর্যার পর সে বেঁচে গেল। তার পরও চলল অব্যাহত যত্ন নেওয়ার পালা। কয়েক মাস বয়সের পর সে বড় হতে থাকল ধীরে ধীরে—অন্য সব সন্তানের মতো। ফুটফুটে মেয়েটির হাসি দেখে তার আত্মীয়স্বজন সবাই খুশি।
মেয়েটির জন্ম হয়েছিল তার যখন জন্ম হওয়ার কথা, তার দুই মাস আগেই। ১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে। মা-বাবা দুজনই তাই অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত ছিলেন। জন্মের পর মা তাকিয়ে দেখেছিলেন সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তানটিকে। দেখলেন, ভারি সুন্দর। চিৎকার করে কাঁদছে। খুশি হলেন মা-বাবা দুজনই। তবে সন্তানটি বাঁচবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা করলেন নামকরা ডাক্তার, দেখাশোনা করছিলেন—এই যা ভরসা। কিন্তু সন্তানটি জন্ম নেওয়ার এক সপ্তাহ পরই তার জটিল সমস্যা দেখা দিল—নিউমোনিয়া হলো। তাকে বাঁচানো যাবে কি না, সেটাই আশঙ্কার কারণ হয়ে দেখা দিল। ডাক্তার তাকে একটি অ্যান্টিবায়োটিক দিলেন ইনজেকশনের মাধ্যমে। বহু চিকিৎসা আর পরিচর্যার পর সে বেঁচে গেল। তার পরও চলল অব্যাহত যত্ন নেওয়ার পালা। কয়েক মাস বয়সের পর সে বড় হতে থাকল ধীরে ধীরে—অন্য সব সন্তানের মতো। ফুটফুটে মেয়েটির হাসি দেখে তার আত্মীয়স্বজন সবাই খুশি।
মুশকিল দেখা দিল মেয়েটির বয়স যখন দেড়-দুই বছর, তখন থেকে। দেখা গেল, মেয়েটি অন্যদের কথায় কোনো রকম সাড়াই দিচ্ছে না। সবাই আশঙ্কা করতে আরম্ভ করল যে সে হয়তো শুনতেই পাচ্ছে না! ভালো ডাক্তাররা দেখলেন তাকে, কিন্তু বিশেষ আশ্বাস দিতে পারলেন না। আরও কয়েক মাস বয়স বাড়ার পর মা-বাবা যখন নিশ্চিত হলেন সে শুনতে পাচ্ছে না, তখনই শুরু হলো বড় ডাক্তারদের চিকিৎসা। কানের বিশেষজ্ঞ দেখানো হলো ভারত, সিঙ্গাপুর, ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ নানা জায়গায়। একজন-দুজন নয়, অনেক ডাক্তার। তাঁরা রায় দিলেন, মেয়েটি শুনতে পায় না। অর্থাৎ, সে শ্রবণপ্রতিবন্ধী, বধির। চিকিৎসায় তেমন কোনো কাজ হবে না, তাও বললেন। কেউ বা বললেন, ধীরে ধীরে খানিকটা উন্নতি হতে পারে। চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে অধীর আগ্রহে মা-বাবা উদ্গ্রীব হয়ে থাকলেন, কিন্তু সে কানে শুনতে পেল না। কয়েক বছর অপেক্ষা করেও না।
মা-বাবা তখন সন্তানটির ভবিষ্যৎ নিয়ে দারুণ দুর্ভাবনায় পড়লেন। তাঁদের অন্য তিন সন্তানই লেখাপড়ায় খুব ভালো। কিন্তু এ সন্তানটি লেখাপড়া শিখতে পারবে না—এটা ভেবে তাঁরা হতাশায় ভেঙে পড়েন! অমন সুন্দর মেয়েটি কথা বলতে পারবে না কোনো দিন! অন্যদের সঙ্গে সত্যিকার যোগাযোগ করতে পারবে না! মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাঁরা চোখে অন্ধকার দেখেন। বাবা বড় ব্যবসায়ী, দেশ-বিদেশে ব্যবসা। রীতিমতো ধনী। কিন্তু তিনি দেখলেন, এই ধনসম্পত্তি সবই হয়ে যাবে অর্থহীন। তার থেকেও দুঃখের কথা: মেয়েটির জীবন হয়ে যাবে একেবারে অর্থহীন। বিদেশ থেকে ডাক্তার নিয়ে এলেন তিনি। ঢাকার শিশু হাসপাতালের অডিও বিভাগের একজন কি দুজন ডাক্তার আর নার্সদের ভারত থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনালেন। (এই হাসপাতালের অডিও বিভাগের একটি উইংয়ের নাম তার বাবা তারই নামে করে দিয়েছেন।) কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো।
অতঃপর কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা। একদিকে মেয়েটির ভবিষ্যৎ; অন্যদিকে নিজের পরিবার, সামাজিক সম্পর্ক, যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, নিজেদের এবং অন্য সন্তানদের জীবন আর ভবিষ্যৎ। কিন্তু না, বাবা মুহাম্মদ ইয়ামীন অগত্যা অত্যন্ত দুরূহ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। তিনি ঠিক করলেন, সবকিছু ছেড়ে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে থাকবেন এমন একটা দেশে, যেখানে মেয়েকে ঠিকমতো লেখাপড়া শেখানো সম্ভব হবে। ইংল্যান্ড থেকে যে শ্রবণ-বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশে, তিনি বুদ্ধি দিলেন ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে। স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগও করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ভর্তির ব্যবস্থা পাকাপাকি হলো।
তারপর বধির সন্তান, স্ত্রী আর একজন সেবিকা—ফাতেমাকে নিয়ে ১৯৯২ সালের ১০ জানুয়ারি মুহাম্মদ ইয়ামীন চলে এলেন ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলের সুন্দর শহর ব্রাইটনে। ঘর বাঁধলেন শহরের কয়েক মাইল দূরে কাকফিল্ডে। সেখানে আছে মূক-বধিরদের স্কুল। ব্রাইটন ইনস্টিটিউশন ফর দি ইনস্ট্রাকশন অব দ্য ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব নামে ব্রাইটনের বধির বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল ১৮৪১ সালে। শ্রবণ-প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা দেওয়ার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে ব্রাইটনের।কাকফিল্ডে যে বধির বিদ্যালয়, তার নাম মিল হল অরাল স্কুল ফর দ্য ডেফ। সেখানেই শুরু হলো মেয়েটির একেবারে প্রাথমিক লেখাপড়া। স্বভাবতই এ স্কুলে শিক্ষা এবং যোগাযোগের মাধ্যম ইংরেজি। এবং সেটাই মেয়েটির জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিল। কিন্তু ধীরে ধীরে মেয়েটি ইংরেজি বর্ণ চিনল, সংখ্যা শিখল। শব্দ, বাক্য এবং অঙ্কও। তারপর ইংরেজি পড়তে ও লিখতে শিখল। স্কুল থেকে বলা হলো মেয়েটির সঙ্গে সারাক্ষণ কথা বলতে। ঠোঁট, মুখ আর জিবের অবস্থান দিয়ে সে যাতে বুঝতে পারে কী বলছে অন্যরা; আর সেটা অনুকরণ করে যাতে সে কথা বলতে চেষ্টা করে।
মেয়েকে যদ্দুর সম্ভব ভালো শিক্ষাদানের জন্য মুহাম্মদ ইয়ামীন চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি। স্কুল মেয়ের খুব ভালো যত্ন নেবে—এই প্রত্যাশায় স্কুলকে টেনিস কোট করে দিলেন, খেলার মাঠের সংস্কার করে দিলেন। স্কুলের শিক্ষকদের খুশি করার জন্য নানা উপায় ঠাওরালেন। বিশেষ করে যা করলেন, তা হলো: শিক্ষকদের প্রায়ই নিমন্ত্রণ করতে আরম্ভ করলেন নিজের বাড়িতে। এ ছাড়া স্কুলের পরামর্শ অনুযায়ী স্ত্রী শামীম ইয়ামীন মেয়েকে বাড়িতে লেখাপড়ায় সাহায্য করতে আরম্ভ করলেন। মেয়েটির ডাকনাম অর্পিতা, আর পোশাকি নাম সাবিরা।
একবার ভাষার বাধা অতিক্রম করার পর অর্পিতা দ্রুত লেখাপড়া শিখতে আরম্ভ করল। সাড়ে চার বছর পর কৃতিত্বের সঙ্গে সে প্রাথমিক স্কুলের লেখাপড়া শেষ করল। মা-বাবা নিজেদের সাফল্যে খুশি হলেন, তার চেয়েও আশান্বিত হলেন মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। কিন্তু কাকফিল্ডে সেকেন্ডারি স্কুল নেই, আছে সেখান থেকে মাইল পঞ্চাশেক দূরে নিউবেরিতে মেরি হেয়ার স্কুল। লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হলে তাই এরপর অর্পিতাকে যেতে হবে মাধ্যমিক স্কুলে। মা-বাবা সে কথা ভেবে কাকফিল্ডের আবাস গুটিয়ে নতুন বাড়ি কিনে নিউবেরিতে বাসা বাঁধলেন।
নতুন স্কুলেও লেখাপড়া চলতে থাকল পুরোদমে। প্রাইমারির তুলনায় এখানে লেখাপড়ার চাপ অনেক বেশি, লেখাপড়ার ধরনও খানিকটা আলাদা। শ্রেণীকক্ষে শেখার বিষয় বেশি, হোমওয়ার্কও বেশি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো: বুঝে শেখার মতো অনেক বিষয় থাকে। বাবা তাই তাকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য একজন হেলপার রাখলেন। আর বাড়িতে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য থাকলেন মা। এখানেও মা-বাবা স্কুলের শিক্ষকদের খুশি করার যদ্দুর সম্ভব চেষ্টা করলেন। তাঁদের আন্তরিক আপ্যায়নে শিক্ষকেরা ধীরে ধীরে তাঁদের আপন হয়ে উঠলেন।
কম্পিউটিং, আর্টস, অঙ্ক ও বিজ্ঞানে অর্পিতা খুব ভালো করতে থাকল। বিশেষ করে, বায়োলজিতে। ছবি আঁকায় সে এমন নৈপুণ্য আর সৃজনশীলতা দেখাল যে একবার তার আঁকা একটি ছবি দিয়ে স্কুল বড়দিন উপলক্ষে বিক্রির জন্য একটি ক্রিসমাস কার্ড ছাপিয়ে আনল। অন্যান্য বিষয়েও সে তার আগ্রহ এবং দক্ষতা দেখাতে শুরু করল। কিন্তু তার প্রধান সমস্যা হলো: নিজের কথা অন্যদের সে যথেষ্ট বোঝাতে পারে না; অন্যদের কথাও সে বুঝতে পারে না। এ নিয়ে সে ভারী বিরক্ত আর হতাশ। একেক সময়ে সে রাগে পাগলামো শুরু করে। মা-বাবাকে টেলিফোনে কথা বলতে দেখে টেলিফোনের তার কেটে দেয় রাগ করে। তাঁরা কেবল কথা বলবেন, হাসবেন—তা কেন? এটা তো অবিচার! তার আচরণে মা-বাবা বিরক্ত হন বটে, কিন্তু মেয়ের দুঃখ তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেন। টেলিফোন করা তাঁরা বন্ধ করতে পারলেন না, কিন্তু গান শোনা বন্ধ করলেন। গাড়ির রেডিও-ক্যাসেট বাজানো বন্ধ করলেন একেবারে।
বাড়িতে অন্যদের নিমন্ত্রণ করেন, যাতে তাঁদের সঙ্গে অর্পিতা কথা বলতে চেষ্টা করে; আবার তাঁরাও তার সঙ্গে কথা বলেন। যোগাযোগ-প্রক্রিয়া যাতে আরও ভালো বুঝতে পারে—সেটাই তাঁদের উদ্দেশ্য। তার স্কুলের বন্ধুদের তাঁরা নিমন্ত্রণ করেন। তারা এলে সমাদর করেন। অর্পিতা কথা বলতে প্রাণপণ চেষ্টা করে। তার এই চেষ্টার জন্য সে একবার নয়, তিনবার স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার লাভ করেছিল। তা সত্ত্বেও তার কথা অন্যরাও ভালো বুঝতে পারে না। সে কথা বলে, কিন্তু অন্যদের কথা শুনতে পায় না বলে সঠিক উচ্চারণে নিজে কথা বলতে পারে না, যদিও অন্যদের কথা সে অনেকটাই বুঝতে পারে তাদের ঠোঁট আর জিব নাড়ানো এবং মুখভঙ্গি থেকে। সমস্ত পৃথিবীটা অর্পিতার কাছে নীরব-নিঝুম। এভাবেই সে বড় হতে থাকল। কিন্তু অত্যন্ত মেধাবী বলে লেখাপড়া সে শিখতে থাকল ঠিকমতো।
মাধ্যমিক স্কুলের শেষ পরীক্ষা—জিসিএসইতে সে উত্তীর্ণ হলো খুবই কৃতিত্বের সঙ্গে। তিনটা বিষয়ে সে পেয়েছিল এ স্টার; দুটোতে এ, আর দুটোতে সি। মা-বাবা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হন। মেয়ের সাফল্যকে তাঁরা নিজেদের সাফল্য বলেই গণ্য করেন—আর সত্যিই তো তাঁদেরও অসাধারণ প্রয়াসের সাফল্য সেটা। কিন্তু এখানেই কি তাঁরা ইতি টানবেন অর্পিতার শিক্ষার? না, সে রকম সিদ্ধান্ত তাঁরা নিলেন না। তাঁরা মেয়েকে আরও সামনে এগিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। অর্পিতা ‘এ-লেভেল’ করতে আরম্ভ করল। কম্পিউটিং আর আর্টে সে সাফল্য দেখিয়েছিল অনেক, কিন্তু ওই দুটি বিষয় সে নিল না। অথচ নিলে কাজটা তার জন্য সহজ হতো। সে জোর দিল বিজ্ঞানের দিকে। হেলপার, শিক্ষকেরা আর বাড়িতে মায়ের যত্নে সে ‘এ-লেভেল’ পরীক্ষাও কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করল।
স্কুলের পালা শেষ। ইংল্যান্ডের বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী এখানেই তাদের লেখাপড়া শেষ করে। অর্পিতাও এ পর্যায়ে তার লেখাপড়া শেষ করতে পারত। কিন্তু তার মা-বাবার উৎসাহ এবং উচ্চাশা গেল আরও বেড়ে। মেয়ে যখন সাফল্য দেখাচ্ছে, তখন আরও এগিয়ে যেতে হবে। নিউবেরির আবাস গুটিয়ে তাঁরা এবার এসে আস্তানা গাড়লেন অক্সফোর্ডে। সেখানে অর্পিতা ভর্তি হলো ব্রুকস বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেয়ের লেখাপড়ায় সাহায্যের জন্য সেখানেও নিয়োগ করলেন হেলপার। যথাসময়ে অর্পিতা বায়োলজিতে প্রথমে অনার্স ডিগ্রি করল চার বছরে। তারপর আরও এক বছর লেখাপড়া করে সে বায়ো-ইমেজিংয়ে এমএসসি শেষ করল কৃতিত্বের সঙ্গে। যেদিন সে এমএসসি পাস করল, সেদিন তার বাবা আমাকে ফোন করে কেবল খবরটা দেননি, সেই সঙ্গে নিজের কথা বলেছিলেন—তিনি ‘ওভার দ্য মুন’। অর্থাৎ, আনন্দে আত্মহারা তিনি। আত্মহারা হওয়ারই কথা। কারণ, তাঁদের ১৫ বছরের কঠিন সাধনায় তাঁরা সফল হয়েছেন। মেয়ের শ্রবণ-প্রতিবন্ধিতা তাঁরা ভালো করতে পারবেন না; কিন্তু তাকে অন্তত আর পাঁচজনের মতো কেন, তার চেয়েও বেশি শিক্ষা দিতে পেরেছেন। অতঃপর অর্পিতার মা-বাবা ভাবতে আরম্ভ করলেন, ১৫-১৬ বছর পর অবশেষে দেশে ফিরে যাওয়ার কথা।
অর্পিতা অবশ্য দেশে ফিরে যেতে চায় না। কারণ সে লক্ষ করেছে, ইংল্যান্ডে প্রতিবন্ধীদের আর পাঁচজন লোকের মতোই মনে করা হয়। বরং তাদের বেশি খাতির করা হয় তাদের প্রতিবন্ধিতার জন্য। অন্যদিকে, বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের অবহেলা করা হয়। অনেকে ব্যবহার করে অস্পৃশ্যদের মতো। আত্মীয়স্বজনও তার সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করে না। এড়িয়ে চলে তাকে। কাজেই সে বাংলাদেশে ফিরে যেতে আগ্রহী নয়। সে বরং ইতিমধ্যে চাকরির জন্য আবেদন করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে চাকরি পেল প্রথম চেষ্টাতেই।
সে তো পড়ানোর কাজ পাবে না! কিন্তু চাকরি পেল গবেষণাগারে—গ্রে ইনস্টিটিউট ফর রেডিয়েশন অ্যান্ড বায়োলজিতে। সেখানে সে গবেষণার কাজ করে তার সহকর্মীদের সঙ্গে। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে সে কাজ করছে সেই গবেষণাগারে। তার সহকর্মী দলের গবেষণার ভিত্তিতে যে গবেষণাপত্র জার্নালে প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে অন্যদের সঙ্গে সাবিরা ইয়ামীনের গবেষণার ফলাফলও থাকছে—যে সাবিরা একেবারে জন্মাবধি পুরোপুরি মূক ও বধির। এ রকমের প্রতিবন্ধিত্ব নিয়ে বাংলাদেশের কোনো ছেলেমেয়ে এমন সাফল্য দেখিয়েছে বলে আমার জানা নেই। অন্য কারও আছে বলেও মনে হয় না। বস্তুত, কেবল বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও একজন প্রতিবন্ধীর এ রকম সাফল্যের দৃষ্টান্ত খুব কমই দেখা যায়, বিশেষ করে লেখাপড়ার জগতে।
তার সাফল্য দেখে সত্যি সত্যি গর্ববোধ করি। সাফল্য কেবল তার একার নয়—অসামান্য সাফল্য তার মা-বাবারও। তাঁদের জন্যও গর্ববোধ করি। তাঁদের আত্মত্যাগ দেখে বিস্ময়ে মাথা নুয়ে যায়। কিন্তু তার সফল বাবার শেষ কথাটা না বলে পারছি না। মেয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ পেয়েছে। দেশে ফিরে যেতে সে চায় না। তাকে জোর করে দেশে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাও নেই তাঁদের। তাই তার অসাধারণ আত্মত্যাগী পিতা প্রতিষ্ঠিত কন্যাকে অক্সফোর্ডে রেখেই দেশে ফিরে যাবেন বলে চিন্তাভাবনা করতে আরম্ভ করেন। আর সত্যি সত্যি একদিন দেশে ফিরে গেলেন। ভিসা বাড়ানোর জন্য পাসপোর্ট পাঠিয়েছিলেন হোম অফিসে। সাত বছর পর সে পাসপোর্ট ফিরে এল স্থায়ীভাবে ইংল্যান্ডে থাকার ভিসা নিয়ে। এত বছর দেশে ফিরতে পারেননি তিনি পাসপোর্টের অভাবে। যখন ফিরে পেলেন, তত দিনে পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। তাই নতুন পাসপোর্ট করলেন মা-বাবা দুজনই। তারপর গত ডিসেম্বরে দেশে ফিরলেন তিন সপ্তাহের জন্য সাবিরা আর সেবিকা ফাতিমাকে সঙ্গে নিয়ে। মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে স্ত্রী এসেছিলেন আগেই।
আসার সময়ে কী ভেবেছিলেন জানি না; কিন্তু দেশ থেকে তাঁর আর ফেরা হলো না। স্নানের ঘরে পড়ে গিয়ে পাঁজর ভেঙে গেল একটি-দুটি নয়, পাঁচটি। সেই সঙ্গে দেখা দিল ফুসফুসের জটিলতা। তা থেকেই গত ২১ জানুয়ারি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে দেশেই থেকে গেলেন মুহাম্মদ ইয়ামীন। এমনিতে তাঁর স্বাস্থ্য ভালো ছিল। ব্যায়ামও করতেন মাঝেমধ্যে। হাঁটতেন প্রায়ই। দুর্ঘটনা থেকেই তাঁর মৃত্যু। কিন্তু তিনি মারা গেলেও পেছনে রেখে গেলেন তাঁর মূর্তিমান সাফল্য—সাবিরাকে; আর সন্তানের জন্য একজন সংকল্পবদ্ধ বাবা কী অসাধ্য সাধন করতে পারেন, সেই তুলনাহীন দৃষ্টান্ত।
সাবিরা ফিরে এল অক্সফোর্ডে। অনেক সম্ভাবনা তার সামনে। অনেক সাফল্য আছে তার জন্য অপেক্ষা করে।
সাবিরা ফিরে এল অক্সফোর্ডে। অনেক সম্ভাবনা তার সামনে। অনেক সাফল্য আছে তার জন্য অপেক্ষা করে।
0 comments:
Post a Comment