সব মা-বাবাই চান যে তাদের আদরের সন্তান সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে বুদ্ধিমান, সবচেয়ে শক্তিশালী, উদার ও সাহসী হয়ে উঠুক। সব মা-বাবাই আশা করেন যে মানুষ যেন তাদের ছেলে বা মেয়েকে কর্মজ্ঞান আর শ্রমশীলতার জন্য শ্রদ্ধা করে। আমাদের সন্তানের সুসামঞ্জস্য ও সর্বাঙ্গীন বিকাশ এ হচ্ছে আমাদের-
- আদর্শ
- পারিবারিক আদর্শ ও
- সামাজিক শিক্ষাদীক্ষার আদর্শ।
কিন্তু মা-বাবা ও শিক্ষক-শিক্ষিকার কী পরিমাণ ধৈর্যপূর্ণ আর দক্ষতাপূর্ণ শ্রম নিয়োগ করা প্রয়োজন যাতে করে আমাদের সন্তানরা মানব সৃষ্ট মেধাগত, নৈতিক ও কান্তি সংস্কৃতির সমস্ত সম্পদ গ্রহণ করে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারে?
মানুষ গড়ে ওঠে ক্রিয়াকলাপে সবারই এ কথা জানা আছে। মানুষের ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যসমূহ বিকশিত হয়-
- শিক্ষাকার্যে
- শ্রমে
- মেলামেশায়
- সৃষ্টিকর্মে ও
- ক্রীড়ায়
আপনার ওপরই নির্ভর করে আপনাদের সন্তান কী রকম হবে। পরিবারেই উদারতার প্রথম শিক্ষা শিশু লাভ করে। এ ব্যাপারে তাকে শিক্ষা দেয় আপনাদের-
- বিচার-বিবেচনা
- আচার-আচরণ
- বাড়িতে, কর্মক্ষেত্রে ও রাস্তাঘাটে মানুষের সঙ্গে আপনার ব্যবহার।
পরিবার হলো এক ধরনের স্কুল, এখানে শিশু-
- ভাবতে
- অনুভব করতে ও
- মানুষের মধ্যে বসবাস করতে শেখে
- আপনজনের কথা
- হাসি
- দৃষ্টি
- ভঙ্গি ও
- অন্যান্য মানুষের প্রতি তার সম্পর্ক শিশু এ সবকিছুই অনুকরণ ও আয়ত্ত করে পৃথিবীকে চেনার সময়, জানার সময়।
শিক্ষণ বিদ্যা যদি ষোলআনা মানুষ গড়তে চায় তাহলে সর্বাগ্রে তার মানুষকেও ষোলআনা জানা দরকার। কিন্তু ‘মানুষকে জানা,’ শিশুকে জানা বলতে কী বোঝায়? আসুন একই বয়সের তিনটি শিশুর দিকে লক্ষ করা যাক। তারা বালুর ওপর খেলা করছে। ফ্যাকাশে চুলো স্বাস্থ্যবতী লিমা এক জায়গায় কিছু পরিমাণ বালু একটু একটু করে জড়ো করল, ‘আমি রাজপ্রসাদ বানাব’। ধীরস্থির রবি ডালপালা এনে বালুতে গাড়তে লাগল, সে পার্ক তৈরি করছে। এমন সময় ছুটে এল নিশা। ‘এই, তোরা এখানে কী করছিস? আমি দুশমন, এক্ষুনি তোদের ওপর হামলা করব’। একটি ডাল দোলাতে দোলাতে সে লাথি মেরে প্রাসাদটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল, লিমা তো কেঁদে একেবারে অস্থির, আর রবি ধীরে-সুস্থে ইতস্তত ছড়ানো ডালাপালা জড়ো করে আবার আগের জায়গায় গাড়তে লাগল। সে আবার পার্ক তৈরি করবে।
যে কথাটি এবার প্রথমে মাথায় আসে তা হলো শিশু তিনটির মধ্যে কোনো রকম মিল নেই। কিন্তু তা কি সত্যি! হ্যাঁ, পরসপরের সঙ্গে যদি তাদের তুলনা করা যায় তাহলে তাদের মধ্যে ঠিকই কোনো রকম মিল দেখা যাবে না। এখানে-
- একটা শিশু শান্ত স্বভাবের
- অন্যটি কাঁদুনে স্বভাবের আর
- আরেকটি শিশু হচ্ছে গোলমেলে টাইপের
কিন্তু আমাদের চার বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের যদি অন্য বয়সের অর্থাৎ বয়সে এক-দুই বছরের ছোট ও বড় শিশুদের সঙ্গে তুলনা করি তাহলে অন্য একটি ব্যাপার ধরা দেবে-তারা কতটা সমান।
তারা সবাই প্রায় একই রকমভাবে কথাবার্তা বলতে পারে। কল্পনা করতে পারে, খেলাধুলা করতে ভালোবাসে, অকপট প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। তার কারণটি হচ্ছে এই যে তারা বিকাশের একই ধাপে অবস্থান করছে। হ্যাঁ, সমস্ত শিশু প্রায় একই বিকাশের পথ অতিক্রম কওে, তবে স্থান ও কালবিশেষে একটু এদিক-সেদিক হতে পারে। এগুলো আমাদের সমস্ত শিশুদের বিকাশের অভিন্ন নিয়মগুলো বোঝার সুবিধা করে দেয়। শিশুকে জানা এর মানেই হচ্ছে ঠিক এই অভিন্ন নিয়মগুলো জানা, আর তারপর প্রতিটি শিশুর ক্ষেত্রে আলাদাভাবে ওই জ্ঞান প্রয়োগ করা।
সন্তানের লালন-পালন
প্রত্যেক মা-বাবাই তাদের আদরের সন্তানের জন্য সুখের শৈশব কামনা করেন। কিন্তু আমরা সুখের শৈশব বলতে কী বুঝি? আমাদের বাচ্চাদের আমরা ভালোভালো পোশাক পরাই, তাদের আনন্দিত, হাসিখুশি ও প্রাণোচ্ছল দেখতে পছন্দ করি। এসবই ভালো দিক, তবে সুখের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র এটি। অনেকেই বলে থাকেন, দারিদ্র্য আর অকাল দুশ্চিন্তার মধ্যে যে ব্যক্তি হয়েছে সে তার সুন্দরতম শৈশব থেকে বঞ্চিত। কিন্তু আমোদ-প্রমোদ ও সীমাহীন আলস্যের মধ্যে অতিবাহিত শৈশবকে কি আমরা সুখী বলে গণ্য করতে পারি? সুখের শৈশব বলতে অনেকের কাছে বোঝায় নিশ্চিন্ত শৈশবকে। কিন্তু মানব জীবন অসাড় হয়ে পড়ে এ অবস্থায়। শিশু-সাবালক নির্বিশেষে মানুষকে বেঁচে থাকার প্রকৃত আনন্দ দিতে পারে একমাত্র বুদ্ধি মনোবল, অনুভূতি ও পেশার সুসামঞ্জস্য প্রয়োগই।
শৈশবের প্রকৃত ধর্ম হচ্ছে-
- কৌতূহল আর আবিষকারের নেশা।
- নতুনত্ব।
- বিস্ময়।
- জ্ঞান ও সৃজন।
- মেলামেশা ও
- গতি।
আর এসব কিছুতে যদি স্নেহশীল পিতা-মাতা শিশুর সঙ্গে থাকেন তাহলেই আমরা সুখী শৈশবের কথা বলতে পারি।
মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সততা-শ্রমশীলতা, মাতৃভূমি রক্ষার্থে আত্মোৎসর্গের মনোভাব-এসব গুণ সাথে নিয়ে কোনো শিশু জন্মায় না। একমাত্র সুশিক্ষার মাধ্যমেই তা অর্জিত হতে পারে। আমরা যখন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখি যে, ভালো পিতা-মাতার সন্তানরাও সাধারণত ভালো হয়, তখন এর অর্থ হতে পারে-
- ওখানে সন্তানদের সযত্নে রক্ষা করা হয়।
- সন্তানদের দেয়া হয় সামাজিক নৈতিকতার উচ্চ মূল্যবোধ।
অবশ্য আমরা এ সত্য অস্বীকার করি না যে প্রত্যেক ছেলেমেয়ের মধ্যে কোনো না কোনো কিছুর প্রতি ঝোঁক থাকে। এ ঝোঁক বা প্রবণতা হতে পারে-
- বিজ্ঞান কিংবা প্রযুক্তির প্রতি
- চিত্রকলার প্রতি অথবা
- গান বাজনার প্রতি
কিন্তু মানুষের নৈপুণ্য, আর প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে থাকে সমাজের মধ্যে এবং সমাজের নানাবিধ কল্যাণের কারণে। এক্ষেত্রে সমাজ ব্যবহার করে অত্যন্ত ফলদায়ক ও ক্ষমতাধর একটি উপায়, আর সেটি হলো শিক্ষাদীক্ষা আর লালন-পালন।
কিছু সমাজবিজ্ঞানী নিপুণতার প্রশ্নটি অদূর অতীতেও এভাবে মীমাংসা করতেন, যেসব মানুষের শিক্ষা আছে তারা তাদের নিপুণ, আর এমনকি সময় সময় তাদের প্রতিভাবান বলেও গণ্য করতেন, কিন্তু যেসব মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা ছিল না তারা তাদের অপরাধের দলে ফেলতেন। উপায়টি ছিল অত্যন্ত সহজ, কিন্তু অতি ভ্রান্ত। এমন বহু বিজ্ঞানীর উদ্ভব ঘটেছিল যারা প্রমাণ করতেন যে শিশুদের সবাই শিক্ষাদীক্ষা করতে, প্রাথমিক স্কুলের পাঠ্যসূচি আয়ত্ত করতেও সক্ষম নয়। কিন্তু তাদের এসব ভাবনা বা কথাবার্তা অযৌক্তিক প্রমাণ হয়েছে। কিশোর-তরুণদের সবাই মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করতে পারে না বলে কোনো কোনো মহলে যে বদ্ধমূল ধারণা ছিল আমরা তার সঙ্গেও একমত নই। আমাদের অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলে। তা সুসপষ্টভাবে প্রমাণ করে যে প্রথম শ্রেণীতে গৃহীত শিশুদের সবাই স্কুলের পাঠ্যসূচি সমাপ্ত করতে সক্ষম সাফল্যের সঙ্গে।
তাই দেখা যাচ্ছে যে, ‘নিপুণতা’ ও ‘প্রতিভা’ কথা দুটির সামাজিক চরিত্র রয়েছে। সাধারণত প্রতিভাহীন মানুষ হয় না। যে অতি বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া। কোনো ছেলেমেয়ে যদি সত্যি সত্যি অপটু ও বোকা হয় তাহলে ঘটতে পারে-
- পিতা-মাতার রোগের কারণে।
- অত্যধিক মদ্যপানের ফলে কিংবা
- শিক্ষাদানের অক্ষমতার জন্য।
তবে শুধুমাত্র বিরল ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে যেকোনো মানুষই কোনো না কোনো ধরনের নৈপুণ্যের অধিকারী।
তাই পরিবার এবং স্কুল-কলেজের কর্তব্য হচ্ছে সেই নৈপুণ্য আবিষকার ও বিকশিত করা।
এক বহুমুখী প্রক্রিয়া হচ্ছে-মানুষ গড়া। তবে এ প্রক্রিয়ায় দুটি দিকই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- অনুভূতি আর হৃদয় গড়ে তোলা এবং
- বুদ্ধির উন্মেষ ঘটানো।
এটা বলাই বাহুল্য যে দিক দুটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু তা সত্ত্বেও এগুলোর মধ্যে পার্থক্য দেখা দরকার।
সন্তানের বিকাশ
সমাজের বাইরে থেকে কি মানুষ হওয়া যায়? সবারই হয়তো জোসেফ কিপলিঙের ‘মাউগলি’ নামক কাব্য রসাত্মক রূপকথাটি জানা আছে। সম্ভবত কারো অজানা নেই তার চেয়ে কম কাব্য রসাত্মক তবে রোমাঞ্চকর ঘটনা আর জটিল সব কৌশলে পূর্ণ টারজানের কাহিনীটিও। বানর পোষিত মানব শিশু, নেকড়ের দ্বারা লালিত-পালিত মানব শিশু, নেকড়ের ঘ্রাণশক্তি ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে, বানরের শক্তি ও চাতুর্যের সঙ্গে মানব বুদ্ধির সমন্বয় ঘটা। দুঃখের বিষয় রূপকথায় শুধু এমনটা ঘটে। বিজ্ঞানের প্রায় ৩০টি জন্তু কর্তৃক শিশু হরণের ঘটনা জানা আছে। এগুলো মোটেই মাউগলি কিংবা টারজানের কাহিনীর মতো নয়।
১৯২০ সালে ভারতে এরকম একটি ঘটনা ঘটেছিল। আর সিং নামে জনৈক ব্যক্তি খবর পেলেন যে একটি গ্রামের কাছে অদ্ভুত দুটি প্রাণ দেখা গেছে। মানুষের মতো দেখতে ওগুলো, হামগুড়ি দিয়ে চলে। প্রাণীগুলোর পিছু নেয়া হলো। আর সিং একদিন তার কয়েকজন শিকারির সঙ্গে নেকড়ের গর্তের কাছে লুকিয়ে থেকে দেখতে পান কীভাবে নেকড়ে তার বাচ্চাদের গর্তের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, বাচ্চাদের মধ্যে দেখা গেল দুটি মানব শিশু। দুটি মেয়েশিশু। একটি শিশুর বয়স হবে ৫ থেকে ৬ বছর আর অন্যটির বয়স হবে ৩ বছর। সেখান থেকে আর সিং মেয়েশিশু দুটিকে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। তিনি বাচ্চা দুটিকে লালন-পালন করার চেষ্টা করলেন। তারা মানুষ দেখলে ভয় পেত, হামাগুড়ি দিয়ে ছোটাছুটি করত, অন্যদের দেখলে লুকিয়ে পড়ত, নেকড়ের মতো খ্যাঁক করে উঠত, আর রাতের বেলায় নেকড়ের মতো আর্তনাদ করত। একদিন দেখা গেল বড় মেয়েশিশুটি উঠানের কুকুরগুলোকে তাড়িয়ে দিয়ে হাড় তুলে নিল এবং নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে তা কামড় দিয়ে খেতে লাগল। আর ছোট মেয়েশিশুটি এক বছর পর মারা যায়। বড় মেয়েশিশুটি বেঁচে ছিল ১৫ বছর। ৯ বছর বয়সে তার নেকড়ে স্বভাবগুলো দূর করা গেল কোনোমতে, তবে তাড়াহুড়ো থাকলে মেয়েটি হামাগুড়ি দিয়েই চলাফেরা করত। সে মানুষের ভাষা অতি কষ্টে শিখতে পেরেছিল। ১১ বছর বয়সে সে মাত্র ত্রিশটি শব্দ জানত এবং ব্যাকরণ বুঝতে শুরু করেছিল জীবনের শেষ দিকে।
সুতরাং এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, মানব সমাজের বাইরে থেকে মানুষের মনুষ্যত্বের গুণাবলি বিকাশ লাভ করতে পারে না।
বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে মানব মস্তিষেকর। তবে বিভিন্নভাবে এ সমস্ত সম্ভাবনা ব্যবহৃত হতে পারে। এমনকি পশুর স্বভাব লাভের উদ্দেশে। আমরা সেটা আগেই লক্ষ করেছি। শিশুর মানুষ হয়ে ওঠার জন্য সে তার জীবন এবং শিক্ষাদীক্ষার মানবীয় পরিবেশের কাছেই ঋণী। এ ধরনের পরিবেশ মানুষকে পশুর চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে উঠতে সাহায্য করে, ভিত্তি গড়ে দেয় মানবোচিত দক্ষতা আর গুণাবলি অর্জনের জন্য।
আমাদের পেছনে রয়েছে বহু শতাব্দীর মানব সমাজ বিকাশের ইতিহাস। এটা আমাদের দক্ষতা নির্ধারণ করে। মানুষের উত্তরাধিকারের জীবতাত্ত্বিক সূত্রের স্থান নিয়েছে উত্তরাধিকারের সামাজিক সূত্র। জীবতাত্ত্বিক ও সামাজিক উত্তরাধিকার সূত্র শিশুর বিকাশে কী পরিমাণ অবদান রাখছে তা মাপা যায় না, উভয় সূত্রে সে ঠিক কী পরিমাণ অবদান রাখছে তা হিসাব করা যায় না। তবে একটা ব্যাপার পরিষকার যে উত্তরাধিকারের সূত্রগুলো প্রকৃতপক্ষে মানুষের বিকাশে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করে থাকে, সামাজিক উত্তরাধিকার সূত্রের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে জীবতাত্ত্বিক উত্তরাধিকার সূত্র, আর সামাজিক উত্তরাধিকার সূত্র গড়ে তোলে মানুষের আচরণ এবং মানুষের দক্ষতা ও মানসিক গুণাবলি।
বহির্জগতের সঙ্গে মেলামেশার প্রধান উপায়সমূহ থেকে বঞ্চিত অন্ধ-বধির-মূক শিশুদের দিকে দৃষ্টিপাত করলে শিশুর বিকাশে এই দুই ধরনের উত্তরাধিকারের ভূমিকার মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করা যায়। শিক্ষাদীক্ষা থেকে বঞ্চিত এই শিশুরা কোনো জিনিস সপর্শ করে না এবং কোনো জিনিস নেয় না। খেলনা দিয়ে কী করে তারা তা বোঝে না, জানে না। এদের মেলামেশার চাহিদা নেই। এ ধরনের শিশুদের সমস্ত মন প্রকৃতি সবচেয়ে সাধারণ দৈহিক চাহিদাসমূহ উপলব্ধির মধ্যে এবং ওই সমস্ত পূরণজনিত সাধারণ সন্তোষ ও অসন্তোষ উপভোগের মধ্যে সীমিত।
অন্যদের দেখে সাধারণ সুস্থ শিশু অনেক কিছু আয়ত্ত করতে পারে, বড়দের সঙ্গে প্রাত্যহিক মেলামেশার প্রক্রিয়ায় সে অনেক কিছু শিখে নেয়, সে তাদের অনেক ব্যাপারেই অনুকরণ করে, কাজকর্ম করতে শেখে জিনিসপত্র নিয়ে। তবে অন্ধ-বধির, মূক শিশুদের ক্ষেত্রে এরকম ঘটে না। এরা উদ্দেশ্যপূর্ণ শিক্ষা ব্যতিরেকে কিছুই আয়ত্ত করতে পারে না, অন্তত প্রথম দিকে তো নয়ই। এ অবস্থায় গবেষকদের তত্ত্বাবধানে মানুষ গড়ার প্রক্রিয়াটি চলে। তাদেরই সামনে। প্রথম দিকে চলে সবচেয়ে সাধারণ চাহিদাগুলো পূরণের সঙ্গে জড়িত ক্রিয়াকলাপ আয়ত্তকরণের কাজ এবং মানবীয় পদ্ধতিতে তা চলে। এরপর শুরু হয় জিনিসপত্রের প্রতি এগুলোর গঠন ও উদ্দেশ্যের প্রতি আগ্রহ জাগরণ, উপলব্ধি ও অনুকরণ প্রক্রিয়ার আবির্ভাব, ধারণা সঞ্চয়করণ এবং শুধু এর ভিত্তিতেই শুরু হয় ভাষা-প্রথমে অঙ্গভঙ্গি আর আকার-ইঙ্গিতের ভাষা, পরে চলে মৌখিক ভাষা আয়ত্তকরণের কাজ। এরূপ শিশুদের শিক্ষা দেয়া হয় বিশেষ স্কুলে।
কোন কোন সামাজিক প্রভাব শিশুর মানসিক গুণাবলি কীভাবে গড়ে তোলে তা নিরূপণের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে চলেছেন।
শিশুদের অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার
অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যা সব বয়সের মানুষকেই আক্রান্ত করতে পারে এমনকি শিশুদেরও। বস্তুত অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার হলো সবচেয়ে কমন ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা শিশুদের বেলায়। এটি ১০% শিশু-তরুণকে আক্রান্ত করে। সব শিশুই কিছু না কিছু অ্যাংজাইটির অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকে, এটা স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত। প্রাক-স্কুল শিশুদের যখন একা রাখা হয় প্রথমবারের মতো, সে সময় অনেক শিশুই যন্ত্রণায় ভোগে। একটি শিশু তার নিজের ঘরে অন্ধকারকে ভয় পেতে পারে। এ ধরনের অ্যাংজাইটি যখন শিশুর স্বাভাবিক কাজকর্মকে বিঘ্নিত করে তখন এটি একটি সমস্যা যেমন-
- স্কুলে যাওয়া
- বন্ধুত্ব তৈরি করা
- হোমওয়ার্ক করা
- ঘুমানো
অব্যাহত এবং প্রচণ্ড অ্যাংজাইটি, যা প্রাত্যহিক জীবনের রুটিনকে ব্যাহত করে তা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা তাতে দ্রুতই হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন।
অনেক ধরনের অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার আছে যার অধিকাংশই শিশুদের বেলায় সচরাচর ঘটে থাকে।
জেনারেল অ্যাংজাইটিতে আক্রান্ত শিশুর ভয়ের এবং উদ্বিগ্নতার পুনরাবৃত্তি ঘটে থাকে যা নিয়ন্ত্রণ তাদের জন্য কঠিন হয়ে দেখা দেয়। এ সময় শিশুরা প্রায় সব কিছুর ব্যাপারেই অ্যাংজাইটিতে ভোগে যেমন-
- স্কুলের ব্যাপারে
- খেলাধুলা
- সময়ে সময়ে
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ
এ সময় শিশুরা বিভিন্ন উপসর্গ অনুভব করে থাকে-
- অস্থিরতায় ভোগে
- খিটখিটে মেজাজ হয়ে যায়
- দুশ্চিন্তাগ্রস্ত
- সহজেই ক্লান্ত হয়ে যাওয়া
- মনোযোগের সমস্যা অথবা
- ঘুমের সমস্যা
জেনারালাইজড অ্যাংজাইটিতে আক্রান্ত শিশু সব সময়ই অন্যদের সন্তুষ্ট করতে ব্যাকুল থাকে এবং তারা সব কাজই নিখুঁতভাবে করতে চায়, তারা তাদের কমতির জন্য অসন্তুষ্ট হয়।
সেপারেশন অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত শিশু তাদের বাড়ি থেকে দূরে থাকা অথবা তাদের যত্নকারীদের থেকে দূরে থাকার দরুন প্রচণ্ড অ্যাংজাইটিতে ভুগে থাকে, যা তাদের স্কুলের কর্মকাণ্ড এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড করার সামর্থ্যকে আক্রান্ত করে। এসব শিশুর তাদের পিতা-মাতার সাথে এবং বাড়িতে থাকার প্রতি প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছা থাকে। এ ধরনের শিশুরা তাদের মা-বাবার কথা মনে করে মাত্রাতিরিক্ত উদ্বিগ্নতায় ভোগে, যখন শিশুর পিতা-মাতা তার থেকে দূরে কোথাও যায় তখন তার খুব কষ্ট লাগতে থাকে। আবার যখন তারা একসাথে থাকে তারা-
- পিতা-মাতার সাথে লেগে থাকে
- স্কুলে যাওয়ার কথা প্রত্যাখ্যান করে
- একা একা ঘুমাতে ভয় পায়
- একা বাথরুমে যেতে ভয় পায়
- ঘন ঘন সেপারেশন হয়ে যাওয়ার দুঃস্বপ্ন দেখে
এর সাথে শারীরিক লক্ষণ যেমন-
- পেটব্যথা
- মাথাব্যথা ইত্যাদি
সমস্যা সেপারেশন অ্যাংজাইটিতে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে দেখা যায়।
সোশ্যাল ফোবিয়া সচরাচর দেখা দেয় তারুণ্যের মাঝামাঝি সময়ে এবং সাধারণত এটি শিশুদের আক্রান্ত করে। তরুণ-তরুণী যারা এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত হয় তারা সামাজিক অথবা দক্ষতামূলক পরিস্থিতি যেমন ক্লাসে কথাবার্তা বলা অথবা জনসমক্ষে খাওয়া-দাওয়া করা এগুলোর প্রতি অনবরত ভয় পেতে থাকে। এই ধরনের ভয় প্রায়ই শারীরিক উপসর্গের সাথে প্রকাশ পায়-
- ঘাম নিঃসরণ
- মুখ রক্তিম হওয়া
- প্যালপিটিশন
- শ্বাসকষ্ট
- শরীর টানটান ভাব
- মাথাঘোরা
- মাথা ঝিমঝিম করা
- অস্থিরতা
তরুণ-তরুণী যারা এই সমস্যায় আক্রান্ত তারা সেই ভয়ের পরিবেশ-পরিস্থিতি বা জায়গা এড়িয়ে চলে। ভয়ের কারণে তারা অনেক সময় বাড়িতেই থাকে। বের হয় না অথবা অনুষ্ঠান বা পার্টি ত্যাগ করে। তরুণ-তরুণী যারা সোশ্যাল ফোবিয়ায় আক্রান্ত তারা প্রায়ই যে কোনো ধরনের সমালোচনায় মাত্রাতিরিক্ত সপর্শকাতর হয়ে থাকে।
- তারা নিজেদের প্রকাশ করতে পারে না
- আত্মমর্যাদার ঘাটতিতে ভোগে
- আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিতে ভোগে সোশ্যাল ফোবিয়া বিশেষ সিচুয়েশনে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। ফলে তরুণ-তরুণীরা ভয় পায়-
- ডেটিং-এ
- আনন্দদায়ক ঘটনায়
শিশুদের যত রকমের অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারজনিত সমস্যা দেখা দিক না কেন সব ডিসঅর্ডারেরই চিকিৎসা আছে। সুচিকিৎসা গ্রহণ করলে অ্যাংজাইটি সমস্যা কেটে যায়।
শিশু ও বড়দের ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার
ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার, যাতে থাকে মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার (ইউনিপোলার ডিপ্রেশন), ডিসথাইমিক ডিসঅর্ডার (ক্রনিক, মাইল্ড ডিপ্রেশন) এবং বাইপোলার ডিসঅর্ডার (ম্যানিক ডিপ্রেশন)। এতে তরুণ-তরুণীর কার্যক্রম ও সমন্বয়ের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ে। শিশু এবং বয়োপ্রাপ্তদের মধ্যে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- অসুস্থতার
- আন্তঃব্যক্তিগত এবং
- মনোসামাজিক সমস্যা তৈরি করে
- যা দীর্ঘস্থায়ীভাবে পরিণতি নিয়ে আসে। বয়োপ্রাপ্তদের মধ্যে এর ফলে ঝুঁকি বাড়ে-
- মাদকদ্রব্য অপব্যবহারের এবং
- আত্মহত্যার আচরণের
দুর্ভাগ্যক্রমে এই ডিসঅর্ডার প্রায়ই শনাক্তহীন হয়ে থাকে পরিবার এবং কখনো কখনো চিকিৎসকদের কাছেও। তরুণদের মাঝে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারের উপসর্গ দেখে প্রায়ই মনে করা হয় এটি নরমাল মুডের ওঠা-নামা বিশেষ করে বিকাশের সময়। এছাড়া হেলথ কেয়ার প্রফেশনালরাও কোনো কোনো সময় তরুণ-কিশোরদের মানসিক অসুস্থতা নির্ণয় করতে অনীহা প্রকাশ করে থাকে। এখনো রোগের দ্রুত ডায়াগনোসিস এবং ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা সংকটপূর্ণ হয়ে আছে-
- স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে
- সুস্থ আবেগের ক্ষেত্রে
- সামাজিক এবং
- আচরণগত বিকাশের ক্ষেত্রে
অসংখ্য এপিডেমিওলজিক্যাল স্টাডিতে দেখা গেছে যে ২.৫% পর্যন্ত শিশু এবং ৮.৩% পর্যন্ত বয়োপ্রাপ্ত ডিপ্রেশনে ভুগছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে ৯-১৭ বছরের শিশুর যে কোনো ধরনের ডিপ্রেশনের ব্যাপকতা ছিল ৬ মাসে ৬%, আর ৪.৯% ছিল মেজর ডিপ্রেশন। এছাড়া গবেষণা নির্দেশ করে যে, গত দশকের চেয়ে বর্তমান সময়ে ডিপ্রেশন ঘটে থাকে জীবনের প্রথম সময়টাতে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রথম জীবনের শুরু হওয়া ডিপ্রেশন প্রায়ই-
- অব্যাহত হতে থাকে/চলতে থাকে
- পুনরাবৃত্তি ঘটে
- প্রাপ্তবয়স্ক পর্যন্ত চলতে থাকে এবং নির্দেশ করেছে যে তরুণ বয়সের ডিপ্রেশন আরো মারাত্মক ডিপ্রেশনের ইঙ্গিত দেয়, যা প্রাপ্তবয়স্কদের ঘটবে। তরুণ-তরুণী যাদের ডিপ্রেশন হয় তাদের এর সাথে অন্যান্য মানসিক ডিসঅর্ডারও থাকে অনেক সময়, সবচেয়ে কমন যেসব মানসিক ডিসঅর্ডার থাকে তা হলো-
- উদ্বিগ্নতা বা অ্যাংজাইটি
- ধ্বংসাত্মক আচার-আচরণ
- সাবস্টেন্স অ্যাবিউজ ডিসঅর্ডার
- শারীরিক অসুস্থতা
শিশু এবং বয়োপ্রাপ্তদের ডিপ্রেশনের ফলে আত্মহত্যার বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ঝুঁকি বা আত্মহত্যার আচরণ দেখা যায়। এ ঝুঁকি বাড়ে বিশেষ করে বয়োপ্রাপ্ত বালকদের বেলায়। যদি ডিপ্রেশন-
- কন্ডাক্টিভ ডিসঅর্ডারের এবং
- অ্যালকোহল বা
- অন্যান্য মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারের সাথে দেখা দেয়
১৯৯৭ সালে আত্মহত্যা ছিল মৃত্যুর তৃতীয় কারণ। যাদের বয়স ১০-২৪ বছর ছিল তারা মৃত্যুর এ তৃতীয় কারণের দলে ছিল।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রিসার্চে খুঁজে পাওয়া গেছে যে বয়োপ্রাপ্তরা যারা মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হয় তাদের ৭% যুবক বয়সে আত্মহত্যা করে। তাই এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যে মা-বাবা এবং ডাক্তার সবাই আত্মহত্যার এই ঝুঁকিকে সিরিয়াসভাবে নেবেন।
গবেষকবৃন্দ বিভিন্ন উন্নয়ন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন শিশু এবং বয়োপ্রাপ্তদের আত্মহত্যার ঝুঁকি প্রতিরোধ করার জন্য-
- তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয়
- সঠিক মূল্যায়ন আত্মহত্যার চিন্তার, উপযুক্ত চিকিৎসা এবং
- যুবক-যুবতীদের মারাত্মক এজেন্ট-আগ্নেয়াস্ত্র এবং ড্রাগ ব্যবহার প্রতিরোধ করে আত্মহত্যার বড় ধরনের ঝুঁকিকে কমাতে চেষ্টা করা। রোগ নির্ণয়ের মাপকাঠি এবং শিশু ও বয়োপ্রাপ্তদের মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার নিরূপণের ফিচার বড়দের মতোই। তবে তরুণ-তরুণীদের নানারকম কারণে রোগ চেনা ও নির্ণয় করা একটু বেশি কঠিন হতে পারে। তরুণ-তরুণীদের বিকাশকালের সময় ডিপ্রেশনের যেসব লক্ষণ প্রকাশ পায় তা বিভিন্ন রকম হতে পারে। এছাড়াও শিশু এবং বয়োপ্রাপ্তদের রোগ নির্ণয় কঠিন হতে পারে কারণ তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কথা বা আবেগ বা মুড স্টেটের বা মন-মেজাজের কথা বর্ণনা করতে পারে না তারা ঠিকমতো। যেমন
- কত খারাপ অনুভূতি তারা অনুভব করছে তা কাউকে মুখ ফুটে বলার পরিবর্তে তারা হয়তো অন্যদের প্রতি বিরক্তি ও রাগ প্রকাশ করতে পারে। এটা অনেক সময় সাধারণ-
- অভদ্র ব্যবহার বা
- অবাধ্যতা বলে ব্যাখ্যা করা হতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, পিতা-মাতারা তাদের সন্তানদের মেজর ডিপ্রেশন খুব কম ক্ষেত্রেই শনাক্ত করতে পারে। এক্ষেত্রে বরং বয়োপ্রাপ্তরা নিজেরাই তাদের সমস্যাকে অনেক সময় চিনতে পারে। বুঝতে পারে।
শিশু ও বয়োপ্রাপ্ত সবাই ডিপ্রেশনের ঝুঁকিপূর্ণ
শিশু, বালক এবং বালিকা এরা সবাই সমানভাবে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু বয়োপ্রাপ্তির সময় বালিকারা বালকদের চেয়ে দ্বিগুণ ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়। যেসব শিশু মেজর ডিপ্রেশনে আক্রান্ত তাদের অনেকের এই ডিসঅর্ডারের পারিবারিক ইতিহাস থাকে। এ ধরনের শিশুদের পিতা-মাতা প্রায়ই প্রথম জীবনে ডিপ্রেশনের অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকে, বয়োপ্রাপ্ত অথবা এডাল্ট অনসেট ডিপ্রেশনে আক্রান্ত পিতা-মাতার চেয়ে। বয়োপ্রাপ্তের ডিপ্রেশনের সাথেও ডিপ্রেশনের পারিবারিক ইতিহাস পাওয়া যায়। তবে এই সম্পর্ক শিশুদের মতো এত উচ্চ নয়।
শিশু ও বয়োপ্রাপ্তদের ডিপ্রেশনের রিস্ক ফ্যাক্টর
- স্ট্রেস বা মনোদৈহিক চাপ
- সিগারেট পান
- মা-বাবার বিচ্ছেদ
- প্রিয় মানুষের বিচ্ছেদ
- রোমান্টিক সম্পর্কের ভাঙন
- মনোযোগগত ডিসঅর্ডার
- আচরণগত বা শিক্ষণ ডিসঅর্ডার
- ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী রোগ-বালাই
- অপব্যবহার
- অবহেলা
- ট্রমা বা ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, প্রকৃতির দুর্যোগ
- বিনা চিকিৎসা বা চিকিৎসাহীন থাকা
লক্ষণ
- অব্যাহত দুঃখ-যাতনা
- ক্রোধান্বিত বা খিটখিটে মেজাজ
- আগে যেসব কিছুতে আনন্দ উপভোগ করা যেত এখন আর তাতে আনন্দ লাগে না বা আগ্রহহীনতা
- খাবার-দাবার গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন
- শরীরের ওজনের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন
- ঘুমের সমস্যা
- অতিরিক্ত ঘুম
- রিটারডেশন বা সাইকোমোটর অ্যাংজাইটেশন
- এনার্জি লস
- মূল্যহীন অথবা অনুপযুক্ত অপরাধবোধ
- মনোযোগে সমস্যা
- মৃত্যুর পুনঃপুনঃ চিন্তা
এসব লক্ষণের ৫টি বা তার বেশি লক্ষণ যদি ২ সপ্তাহ বা তারও বেশি সপ্তাহ ধরে চলে তাহলে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার ভাবা যেতে পারে।
শিশু ও বয়োপ্রাপ্তদের আরো যেসব চিহ্ন ডিপ্রেশনের সময় দেখা যেতে পারে তা হলো-
- ঘন ঘন অসপষ্ট অ-সুনির্দিষ্ট শারীরিক অভিযোগ যেমন-
- মাথাব্যথা
- শরীর ব্যথা
- পেটব্যথা অথবা
- দুর্বলতা
- ঘনঘন স্কুলে অনুপস্থিত থাকা অথবা স্কুলে খারাপ রেজাল্ট করা
- বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা বলা বা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা
- চিৎকার-চেঁচামেচি করা
- বারেবারে নানা অভিযোগ করতে থাকা
- ব্যাখ্যাহীন খিটখিটে মেজাজ
- ক্রন্দন
- একঘেয়ে অনুভব করা
- বন্ধু-বান্ধবদের সাথে খেলাধুলা করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা
- মদ বা অন্যান্য মাদকদ্রব্য অপব্যবহার করা
- সামাজিকভাবে নিজেকে আলাদা করে নেয়া
- কোনো প্রত্যাখ্যানের প্রতি চরম সপর্শকাতরতা
- কোনো ব্যর্থতায় ভেঙে পড়া
- রাগ বৃদ্ধি পাওয়া
- বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন হওয়া
- বেপরোয়া আচরণ
- কোনো সম্পর্ক বজায় রাখতে সমস্যা হওয়া
যখন শিশু এবং বয়োপ্রাপ্তদের মধ্যে মেজর ডিপ্রেশনের এপিসোডের একক ঘটনা হতে আরোগ্যর হার অনেক বেশি তখনো ডিপ্রেশনের এপিসোড পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে, আবার যুবক যারা ডিসথাইমিক ডিসঅর্ডারে ভুগছে তারা মেজর ডিপ্রেশনে উন্নীত হতে পারে, এ ক্ষেত্রে উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। দ্রুত রোগ শনাক্তকরণ এবং দ্রুত চিকিৎসা কমাতে পারে ডিপ্রেশনের-
- মেয়াদ
- প্রচণ্ডতা
- জটিলতা এবং
- সহযোগী ক্রিয়াগত গোলযোগ।
এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার পিতা-মাতার জন্য যে তাদের শিশুদের ডিপ্রেশনকে বুঝতে পারা, চিনতে পারা এবং দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। চিকিৎসক পিতা-মাতার বিভিন্ন উদ্বেগ ও প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন। এ কথা আবার মনে করা দরকার যে, ডিপ্রেশন শিশু ও বয়োপ্রাপ্তদের মাঝে দেখা দেয়া একেবারে কমন ব্যাপার। তবে এক্ষেত্রে পিতা-মাতার জন্য আশ্বস্তকরণ যে কথা রয়েছে তা হলো ডিপ্রেশন যত কঠিনই হোক না কেন এটি উপযুক্ত চিকিৎসা, সাইকোথেরাপি, ওষুধ প্রয়োগ অথবা কম্বিনেশন ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে সারানো সম্ভব। ফলে শিশু ও বয়োপ্রাপ্তরা তাদের বাড়ি, স্কুল ও পরিবারে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে পারবে।