নাক কান ও গলা




নাক কান গলা শরীরের এই তিনটি অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি হতে পারে সাধারণ হাঁচি-সর্দি থেকে শুরু করে গলার ক্যান্সার সবই রয়েছে এই তালিকায় স্বল্পপরিসরে সেইসব রোগের কয়েকটি সম্পর্কে ধারণা দেয়া হল টনসিলের ইনফেকশন: সবচেয়ে পরিচিত এই টনসিলের সমস্যা এটি মূলত শিশুদের সমস্যা বড়দেরও হয় টনসিলের সমস্যায় গলাব্যথা, খেতে গেলে ব্যথা, সামান্য জ্বর ইত্যাদি থাকে প্রথমত ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয় বারবার হতে থাকলে সম্যক জটিলতা কষ্টের কথা বিবেচনা করে টনসিল অপারেশন করিয়ে নিতে হয় সারা পৃথিবীতে শিশুদের যত অপারেশন হয় তারমধ্যে টনসিল অপারেশনের অবস্থান সবার শীর্ষে এডিনয়েড বড় হওয়া: এটি শিশুদের রোগ নাকের ছিদ্রের পিছন দিকে যে অঞ্চলটি রয়েছে সেখানে এই এডিনয়েড নামক লসিকা গ্রন্থির অবস্থান এটি অনেক সময় বড় হয়ে নাক আংশিক বন্ধ করে দেয়ে ফলে নাক দিয়ে অধিকাংশ সময়েই সর্দি ঝরে কানের সাথে নাকের পিছনের অংশের যোগাযোগরক্ষাকারী টিউবটির মুখও আংশিকভাবে বন্ধ থাকে ফলে কানও বন্ধ থাকে কানের মধ্যে পানির মত তরল জমে কান ব্যথা করে এডিনয়েড বড় হলে শিশু মুখ দিয়ে শ্বাস নেয় ঘুমের মধ্যে শ্বাসবন্ধ হয়ে জেগে ওঠে রোগীর চেহোরা ক্রমশ হাবাগোবা হয়ে পড়ে অনেক অভিভাবকই সমস্যাটির ফলে সৃষ্ট ক্ষতি অনুধাবন করেন না ফলে শিশুর অনেক ক্ষতি হয় অপারেশনই হচ্ছে এর একমাত্র চিকিৎসা ভোকাল কর্ডে পলিপ: এটি শ্বাসতন্ত্রের অনর্-গত সমস্যা গলায় স্বর তৈরির স্থানটি হচ্ছে ল্যারিংস সেখানেই থাকে ভোকাল কর্ড কর্ড দুটির কাঁপুনিতেই সৃষ্টি হয় শব্দ ভোকাল কর্ড বেশি ব্যবহৃত হলে এবং ল্যারিংসে ইনফেকশন হলে গলার স্বর ভেঙ্গে যায় স্বরভঙ্গের প্রথম চিকিৎসা হচ্ছে -১০দিন কথা বলা সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করে দেয়া স্বরের পরিমিত বিশ্রামের অভাবে গলা ভাঙ্গলে ভোকাল কর্ডে দানার মতো দেখা দেয় যাকে বলা হয় ভোকাল কর্ড স্বর ব্যবহারকারী যেমন- সঙ্গীত শিল্পী , শিক্ষক এদের ভোকালকর্ডে পলিপ বেশি দেখা দেয় পলিপ হলে চিকিৎসা অপারেশন গলায় ক্যান্সার: ক্ষেত্রে ল্যারিংসের ক্যান্সারকেই বোঝানো হয়েছে খাদ্যনালীর ক্যান্সারকেও গলায় ক্যান্সার বলা যেতে পারে ল্যারিংসের ক্যান্সার বলতে শ্বাসতন্ত্রের যেখানে থেকে স্বর তৈরি হয় সে অঞ্চলের ক্যান্সারকে বোঝায় আর খাদ্যনালীর ক্যান্সার বলতে বোঝায় খাদ্যনালীর উপরের অংশের ক্যান্সারকে বোঝানো হয় ল্যারিংসের ক্যান্সার হলে তাই গলার স্বর পরিবর্তন হয়ে যায়, সমস্যা তীব্র হয়ে শ্বাসনালী বন্ধ করার উপক্রম হলে শ্বাস কষ্ট শুরু হয় অন্যদিকে খাদ্যনালীর ক্যান্সারের সমস্যা শুরু হয় গলায় ব্যথা খেতে অসুবিধা হওয়ার মধ্য দিয়ে সমস্যা তীব্র হলে খাদ্যনালী বন্ধের উপক্রম হলে রোগী কিছুই খেতে পারে না অবস্থাভেদে এর চিকিৎসা- অপারেশন, রেডিওথেরাপি কেমোথেরাপি

মানুষ যখন মনের ভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করকতে চায় তখন তার ভাষা শ্রুতিমধুর, সুন্দর, সুমিষ্ঠস্বর, সুস্পষ্ট উচ্চারণ প্রত্যাশা করে কিন্তু বিভিন্ন কারণে সে তার মনের ভাব সঠিকভাবে প্রকাশে ব্যর্থ হয় এবং দুঃশ্চিন্তায় ভুগতে থাকে ক্রমান্বয়ে সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে এসব জটিল সমস্যা দূর করার জন্য মানুষ দেশ থেকে বিদেশ যেত বর্তমানে বিএসএমএমইউ (পিজি হাসপাতাল)- স্পীচ থেরাপী চালু করা হয়েছে কথা বলতে সমস্যা হয় এমন রোগী এই দেশে অনেক চোখে পড়ে শিশু যখন কথা বলতে পারে না তখন পরিবারের সবাই হতাশায় ভুগতে থাকেন শিশুদের আধো আধো কথা থেকে সবাই আনন্দ উপভোগ করতে চায় বিভিন্নভাবে মানুষ একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করে ভাষা এবং যোগাযোগ এক কথা নয় শিশু জন্মের পর থেকেই বিভিন্নভাবে তার প্রয়োজন মেটায় যেমন ক্ষুধা লাগলে কাঁদে, মা তার কান্না থেকে বুঝতে পারে শিশুর খাবারের প্রয়োজন কিন্তু শিশু যখন আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে তবুও কথা বলে না, তখন মা-বাবা দুঃশ্চিন্তায় ভুগতে থাকেন শিশুর ভাষা শিখার গুরুত্বপূর্ণ সময় দেড় বছর থেকে চার বছর পর্যন্ত যেসব শিশু সঠিক সময়ে, সঠিকভাবে কথা বলতে পারে না, শুধু তারাই নয়, শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষের কথা বলার সমস্যা যেমন- তোঁতলানো, অস্পষ্ট উচ্চারণ, কক্তস্বর পরিবর্তন, জিহ্বা আটকানো, স্ট্রোক, নাকে স্বরে কথা, অতি চঞ্চল রোগীদের চিকিৎসা দেশেই সম্ভব
কথা বলার জন্য কানে শোনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগে শোনা পরে বলা। শিশু বাক প্রতিবন্ধীতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে না, শুনতে পায় না বলেই কথা শিখতে পারে না। সব বয়সী লোকেরই কানে শোনার সমস্যা থাকতে পারে। যে সব শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুরা একেবারেই শুনতে পায় না তাদেরকে বিশেষ স্কুলে দেয়া যেতে পারে এবং অন্যান্য ছেলেমেয়েরা যা শেখে সেই একই বিষয় তারা যোগাযোগের বিশেষ পদ্ধতিতে শিখতে পারে। আর যেসব শিশু কিছু শুনতে পায় তাদেরকে স্পীচ থেরাপীর মাধ্যমে কথা শিখানো সম্ভব। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ কোন না কোন সমস্যায় ভুগে থাকেন। সমস্যা যখন জটিল আকার ধারণ করে তখন মানুষের মস্তিষ্কে চাপ পড়ে। মস্তিষ্ক আমাদের শরীরের সমস্ত কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যেমন- কথা বলা, হাঁটা-চলা, চিন্তা-ভাবনা এসব। মস্তিস্কে প্রেসার এর কারণে স্ট্রোক করে। ফলে রোগীর বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। যেমন- সঠিকভাবে কথা বলতে না পারা, মুখ দিয়ে লালা আসা, অন্যের কথা বুঝা কিন্তু নিজে বলতে না পারা। এসব রোগীকে স্পীচ থেরাপী দিলে দ্রুত আরোগ্য লাভ করে
গলায় অবস্থিত ল্যারিংস বা শব্দযন্ত্রে দুটি ভোকাল কর্ড বা কণ্ঠনালি থাকে এই নালি দুটির কম্পনের মাধ্যমে শব্দ তৈরি হয় নিঃশ্বাসের সময় ফুসফুস থেকে প্রবাহিত বাতাস কণ্ঠনালিতে কম্পনের সৃষ্টি করে কথা বলা বা গান গাওয়ার সময় এই কম্পনের পরিমাণ প্রতি সেকেন্ডে ১০০ থেকে এক হাজার বার একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দিনে এক মিলিয়ন বার কণ্ঠনালি দুটির সংস্পর্শ হয় অতএব চিন্তা করুন আমাদের কণ্ঠনালির ওপর আমরা কতটুকু নির্ভরশীল-ঘরে-বাইরে, সব খানে সব সময় তাই আমাদের কণ্ঠনালি তথা কণ্ঠকে সুস্থ রাখা খুবই জরুরি
কীভাবে কণ্ঠকে সুস্থ সুন্দর রাখা যায়
প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে পানি পান করবেন, কমপক্ষে দুই থেকে তিন লিটার পানি পান করতে হবে। পানি কণ্ঠনালিকে আর্দ্র রাখে এবং আর্দ্র কণ্ঠনালি শুষ্ক কণ্ঠনালির চেয়ে বেশি ব্যবহার করা যায়। খেলা শুরুর আগে যেমন প্রস্তুতি দরকার, তেমনি দীর্ঘ বক্তৃতার আগে কণ্ঠনালির একইভাবে হালকা ব্যায়াম করা উচিত। প্রস্তুতি ছাড়া কোনো কাজে নামা ঠিক নয়। অনুশীলন করলে কণ্ঠের মান উপস্থাপনা সুন্দর হয়। কথা বলা গান গাওয়ার মাঝখানে দীর্ঘ শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে কথা বলা, গান গাওয়াকে সুন্দর করে এবং কণ্ঠনালির অবসাদ হয় না। বক্তব্য বা উপস্থাপনা বা বড় সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় মাইক্রোফোন ব্যবহার করা ভালো। দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় কণ্ঠনালিকে বিশ্রাম দেওয়া উচিত, যা কণ্ঠনালির অবসাদ দূর করে এবং শক্তি ফিরিয়ে দেয়। নিজের কণ্ঠকে শুনুন এবং যদি কোনো রকমের উপসর্গ থাকে বা পরিবর্তন লক্ষ করেন, তাহলে যথাযথ যত্ন নিন। যদি দুই সপ্তাহের বেশি স্বর পরিবর্তন লক্ষণীয় হয় তাহলে নাক, কান গলাবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। এমন কিছু করবেন না, যা কণ্ঠনালির ক্ষতি হয়
ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ধূমপান কণ্ঠনালির ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। ছাড়া ধূমপান কণ্ঠনালির প্রদাহ করে। জোরে জোরে বা পরিবর্তিত স্বরে কথা বলা উচিত নয়। জোরে কথা বললে বা কণ্ঠনালির অপব্যবহার করলে কণ্ঠনালিতে সূক্ষ্ম আঘাত হতে পারে। দূর থেকে কাউকে ডাকতে হলে হাততালি বা শিস বা হাত নেড়ে অথবা লাইটের মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। বড় খেলা উপভোগ করার সময় পছন্দের দলকে সাপোর্ট করার জন্য জোরে চিৎকার না করে পতাকা ওড়ান বা ব্যানার লেখেন।এমন কিছু খাবেন না, যাতে এসিডিটি হতে পারে। তাই মাথা উঁচু করে ঘুমাবেন, টাইট কাপড় পরে ঘুমানো যাবে না, হালকা ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করে ঘুমাবেন। খাবারের সঙ্গে সঙ্গে ঘুমানো বা ক্যাফেইনযুক্ত খাবার গ্রহণ করা বাদ দিতে হবে। দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে কণ্ঠনালিতে চাপ পড়ে এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকবেন। মোবাইল ফোনে কথা বলতে সাবধানতা অবলম্বন করুন। গাড়িতে বা ট্রেনে ভ্রমণের সময় কণ্ঠনালিকে বিশ্রাম দিন। দৈনন্দিন খাবারের সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করবেন না। মোবাইল ফোনে অতিরিক্ত কথা বললে কণ্ঠনালিতে চাপ পড়ে। চিন্তা করুন, ফোন কলটি আপনার প্রয়োজনীয় কি না। শব্দপূর্ণ পরিবেশে মোবাইল ফোনে উচ্চ স্বরে কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। এতে কণ্ঠনালির বিশ্রাম হবে
কণ্ঠনালির সমস্যার কারণ
যদি ঘন ঘন কণ্ঠস্বর পরিবর্তন হয় বা দীর্ঘ ১৫ দিন বা দুই সপ্তাহে ভালো হচ্ছে না তবে নাক, কান গলাবিশেষজ্ঞকে দেখাতে হবে। বিভিন্ন কারণে কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন হতে পারে। কণ্ঠস্বর বা কণ্ঠনালির বিভিন্ন সমস্যা
নিচে তুলে ধরা হলো-
কণ্ঠনালির তীব্র প্রদাহ
কণ্ঠস্বর পরিবর্তনের প্রধান কারণ হলো কণ্ঠনালির তীব্র প্রদাহ। সাধারণত ভাইরাসজনিত কারণে প্রদাহ হয়, কণ্ঠনালি ফুলে যায়, যাতে কণ্ঠনালির কম্পনের সমস্যা সৃষ্টি করে। ফলে স্বর পরিবর্তন হয়। প্রচুর পানি খেলে, কণ্ঠনালিকে বিশ্রাম দিলে এটা ভালো হয়ে যায়। তীব্র প্রদাহ অবস্থায় যদি জোরে কথা বলেন তা কণ্ঠনালির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। তবে যেহেতু তীব্র কণ্ঠনালির প্রদাহ ভাইরাসজনিত তাই এতে অ্যান্টিবায়োটিক লাগে না। যদি ব্যাকটেরিয়াজনিত প্রদাহ হয় তবে এর সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হয়, যার বিশেষ চিকিৎসা দরকার
দীর্ঘমেয়াদি ল্যারিনজাইটিস
পাকস্থলীর এসিড রিফলাক্সের জন্য কণ্ঠনালির দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ হতে পারে। ধূমপান, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানির জন্য ইনহেলার ব্যবহার বা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের দীর্ঘমেয়াদি ল্যারিনজাইটিস হতে পারে
কণ্ঠস্বরের অতি ব্যবহার
কথা বলার সময় কণ্ঠনালির সঙ্গে আশপাশে অবস্থিত মাংসপেশিরও সাহায্য লাগে। কণ্ঠনালিকে সঠিক নিয়মের বাইরে ব্যবহার করা, কঠিন উচ্চ স্বরে, অতিরিক্ত, দীর্ঘমেয়াদি বা পরিবর্তিত স্বরে কথা বললে কণ্ঠনালির প্রদাহ দেখা যায়, যা ভারী জিনিস ঠিকভাবে না ওঠানোর জন্য পিঠে ব্যথা হওয়ার সমতুল্য। গলা শব্দযন্ত্রের মাংসপেশির সংকোচন এবং কথা বলার সময় ঠিকভাবে শ্বাস না নিলে শ্বাসযন্ত্রের অবসাদ হয়, কথা বলতে কষ্ট হয় এবং কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে কণ্ঠনালিতে পলিপ বা নডিউল এমনকি রক্তক্ষরণও হতে পারে
কণ্ঠনালির অপব্যবহারের কারণ
কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে জোরে কথা বলা। অতিরিক্ত দীর্ঘ সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা। ঘাড় কানে ফোন চেপে ধরে কথা বলায় ঘাড় শব্দযন্ত্রের মাংসপেশিতে টান লাগে। উচ্চ স্বরে বা চিৎকার করে কথা বলা, জনসমাবেশে বা বড় লেকচার গ্যালারিতে মাইক ছাড়াই জোরে কথা বলা প্রভৃতি
কম ক্ষতিকারক কণ্ঠনালির রোগ
দীর্ঘমেয়াদি কণ্ঠনালির অপব্যবহারে যে ক্ষতি হয় পরবর্তী সময়ে তা কণ্ঠনালির কম্পনের মাত্রার ওপর প্রভাব ফেলে এবং কণ্ঠনালির পলিপ, নডিউল বা সিস্ট হতে পারে। নডিউল সাধারণত কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে বেশি হয়। রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, আইনজীবী, অধিক সন্তানের জননী, মসজিদের ইমাম হকারদের মধ্যে এসব রোগ হতে পারে। চিকিৎসা হলো অপারেশন ভয়েস থেরাপি
কণ্ঠনালিতে রক্তক্ষরণ
জোরে চিৎকার করলে বা গলায় বেশি শক্তি দিয়ে কথা বললে বা গলায় আঘাত পেলে হঠাৎ করে কথা বন্ধ হতে পারে। কণ্ঠনালির সূক্ষ্ম রক্তনালি ছিঁড়ে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। অবস্থায় কথা বলা বন্ধ রাখতে হবে যত দিন জমাট রক্ত মিলিয়ে না যায়
কণ্ঠনালির প্যারালাইসিস বা দুর্বলতা
কণ্ঠনালি কিংবা শব্দযন্ত্রের স্মায়ুর দুর্বলতা বা কোনো সমস্যার জন্য কণ্ঠনালির পরিবর্তন হতে পারে। ভাইরাসজনিত প্রদাহের কারণে স্মায়ু দুর্বল হয়। সাধারণত এক দিকের স্মায়ুই দুর্বল হয়, দুই দিকের স্মায়ু একই সঙ্গে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। এক দিকের স্মায়ুর দুর্বলতার কারণ হচ্ছে ভাইরাস সংক্রমণ, টিউমার, ক্যান্সার থাইরয়েড অপারেশন। কণ্ঠনালির দুর্বলতার জন্য ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ হয় এবং এটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে জড়িত। কয়েক মাসের মধ্যে একদিকের দুর্বলতা ভালো হয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কণ্ঠনালির দুর্বলতা ভালো হয় না, তখন চিকিৎসার প্রয়োজন হয়
কণ্ঠনালির ক্যান্সার
যেকোনো ক্যান্সারের মতোই গলার ক্যান্সার বা কণ্ঠনালির ক্যান্সারকেও মোটেই অবহেলা করা উচিত নয়। গলার স্বর পরিবর্তন ১৫ দিনের মধ্যে ভালো না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার নির্ণয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কণ্ঠনালির ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করে চিকিৎসা নিলে তা পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়
আধুনিক বিশ্বে ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে হাজার হাজার শিশু এই ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জারীর কল্যাণে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাচ্ছে ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টের ইতিহাস প্রায় ২০০ বৎসরের পুরাতন আলেসান্দা ভল্টা যিনি ইলেকট্রিক ব্যাটারীর আবিষ্কারক তিনিই বিষয়ে প্রথম কথা বলেন উইলিয়াম হাউস ১৯৬৯ সালে সর্বপ্রথম মানুষের কানে ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টের সুপারিশ করেন এবং ১৯৬৯-৭০ সালে তিনজন রোগীর সফল ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জারি করেন ১৯৭৮ সালের আগস্ট তারিখ মেলবোর্নের অধিবাসী রডসুন্দরসের কানে বিশ্বে প্রথম মাল্টি চেনেল ইমপ্ল্যান্ট লাগান হয় একজন বধির শিশুর সবময়ই বোবা হয় সে কথা বলতে পারে না কারণ কথা বলার জন্য কথা শিখতে হয় আর শিখার জন্য শোনার প্রয়োজন হয় যে শুনতে পায় না সে শিখতে পারে না, আর না শিখতে পারলে বলতে পারে না
স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলো মানুষ কানের মাধ্যমে শুনতে পায়। কানের তিনটি অংশ থাকে, বহিঃকর্ণ, মধ্যকর্ণ অন্তঃকর্ণ। অন্তঃকর্নে থাকে একটি মেশিন যার নাম ককলিয়া। এটা দেখতে অনেকটা শামুকের মত। বাইরের শক্ত হাড়ের ভিতর থাকে অতি সংবেদনশীল মেমরেনাস ককলিয়া। এটাই শোনার প্রধান কাজ করে। বহিঃকর্ণ মধ্যকর্ণ শব্দকে পরিবেশ থেকে ধারণ করে তা ককলিয়ায় পাঠায়, ককলিয়া এইসব শব্দ থেকে প্রয়োজনীয় শব্দকে বাছাই করে প্রক্রিয়াজাত করে কানের নার্ভে প্রেরণ করে এবং নার্ভের মাধ্যমে শব্দ ব্রেইনের শ্রবণ এলাকায় যখন পৌঁছে তখন মানুষের মস্তিষ্কে একটি অনুভূতির সৃষ্টি হয় এবং সেটাই শ্রবণ এবং এই অনুভব তার স্মৃতিশক্তিতে জমা হয়। এই শব্দ যখন আবার মস্তিকে পৌঁছায় তখন স্মৃতিশক্তি বলে দেয় এই শব্দের অর্থ কি। এই ভাবেই মানুষ ভাষা শিখে। যে জন্য শিশু ছোটবেলা যে পরিবেশে থাকে সেই ভাষাই শেখে যেমন জঙ্গলে থাকলে সে পশুর ডাক শিখে। এই ককলিয়া যাদের তৈরি হয় না বা নষ্ট হয়ে যায় তখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং শিশুরা শুনতে পায় না, ফলে ভাষা শিখতে পারে না। এই ককলিয়াকে ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করার নামই হলো ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট। বিশেষ ইন্দ্রিয় যেমন শ্রম্নতি, দৃষ্টি, ঘ্রাণ, স্বাদ, স্পর্শ এর মধ্যে শুধু শ্রুতিকেই পর্যন্ত কৃত্রিমভাবে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এটা একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার। এর বিস্ময়কর ক্ষমতার জন্য একে বায়োনিক কানও বলা হয়
ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টের কয়েকটি অংশ থাকে। এর কিছু কানের ভেতরে সার্জারির মাধ্যমে লাগিয়ে দেয়া হয় আর কিছু অংশ কানের বাইরে থাকে। একটি চুম্বক জাতীয় বস্তু ভেতরের যন্ত্রের সাথে বাইরের যন্ত্রের সংযোগ রক্ষা করে। একটি মাইক্রোফোন থাকে যা বাইরের শব্দকে সংগ্রহ করে। স্পীচ প্রসেসর এই সংগৃহীত শব্দকে প্রক্রিয়াজাত করে কানের ভেতরের প্রতিস্থাপিত রিসিভারে পাঠায়, এই রিসিভার থেকে একটি সূক্ষ্ণ তার ককলিয়ার হাড়ের ভেতর পৌঁছে যা রিসিভার থেকে শব্দকে কানের নার্ভে পৌঁছে দেয়। নার্ভ এই শব্দ তরঙ্গকে ব্রেইনের শ্রম্নতি এলাকায় পৌঁছায় তখন মানুষ শুনতে পায়। একটি চুম্বক জাতীয় ট্রান্সমিটার বাইরের যন্ত্রের সাথে ভেতরের যন্ত্রের সংযোগ রক্ষা করে। বাইরের যন্ত্রের জন্য ব্যাটারী দরকার হয়
কাদের জন্য এই সার্জারী প্রয়োজনঃ যে শিশুর জন্মের সময় ককলিয়ার তৈরি হয়নি বা জন্মের পরে ককলিয়ার নষ্ট হয়ে গেছে তাদের জন্য এই অপারেশন অপরিহার্য। আরেক গ্রুপ আছে যারা জীবনের কোন পর্যায়ে হঠাৎ করে সম্পূর্ণ বধির হয়ে গেছে তাদের শ্রবণ শক্তি ফিরিয়ে দেবার জন্য এই ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট জরুরী
যে শিশু জন্ম থেকেই বধির তাকে বৎসরের পূর্বে ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টি লাগিয়ে দিলে স্বাভাবিক নিয়মে সে বড় হতে থাকে এবং ভাষা শিখতে থাকে। তাহলে সে খুবই উপকৃত হবে এবং স্বাভাবিক জীবন ফিরে যেতে পারবে। - বৎসর সময়টা শিশুর ভাষা শেখার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে ব্রেইন ভাষা শিখার কাজটি সম্পন্ন করে। এই সময়ে যদি শিশুকে শোনার ব্যবস্থা না করা হয় তবে শিশুর ভাষা শিখানো কঠিন হয়ে পড়ে। পৃথিবীতে অনেক নামী-দামী লোক আছেন যারা ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টি মিস এমেরিকা ১৯৯৫, একজন ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টি। ব্রিটিশ কয়েকজন এমপি আছেন যারা ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টি
ব্রেইনের নির্ধারিত শ্রুতি এলাকায় যদি কোন ইনপুট অর্থাৎ শব্দ না দেয়া হয় তবে আউটপুট অর্থাৎ ভাষা শেখা সম্ভব হয় না। তাছাড়া শ্রুতি এলাকায় ইনপুট না পৌঁছালে অন্য এলাকার ইনপুট সেটা দখল করে নেয় যেমন দৃষ্টির এলাকা বিস্তৃত হতে পারে শ্রুতির এলাকা পর্যন্ত। সে জন্য দেখা যায় শ্রম্নতি প্রতিবন্ধীদের দৃষ্টি খুবই প্রখর হয় এবং অনেক শ্রুতি প্রতিবন্ধী দেখেই মানুষের ছবি একে দিতে পারে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। ঘোড়ার বাচ্চার ব্রেইনে একটি প্রোগ্রাম থাকে জন্মের পরই সে দাঁড়াবে এবং কিছুক্ষণ পরই সে দৌড়াতে পারবে। এই বচ্চাটিকে যদি জন্মের পর পর পায়ে ব্যান্ডেজ দিয়ে সপ্তাহ শুইয়ে রাখা হয় তবে সেই ব্যান্ডেজ খেলার পর আর সে হাঁটতে পারবে না কারণ ততদিনে তার ব্রেইনের হাঁটার প্রোগ্রাম মুছে গেছে এবং অন্য প্রোগ্রাম এটা দখল করে নিয়েছে। সেজন্যেই বাচ্চাদের - বৎসরের মধ্যে অপারেশন করানো জরুরী। এরপর অপারেশন করালে শব্দ শুনতে পেলেও সে শব্দের অর্থ বুঝা এবং ভাষা শিখা খুব একটা সহজ হয় না। ব্রেইনের এই নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কাজ শেখার ক্ষমতাকে বলা হয় নিউরাল প্লস্টিসিটি
অন্য আরেকটি গ্রুপ আছে যা স্বাভাবিক কথা শেখার পর হঠাৎ করেই সম্পূর্ণ বধির হয়ে গেছে তাদের জন্য এই অপারেশন অপরিহার্য এবং এটা যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই ভাল। বেশি দেরী হলে শেখা কথা এক সময় ভুলে যায়। মাসের মধ্যে হলে ভাল হয়
কি কারণে শিশুরা বধির হয়ঃ প্রকৃতির খেয়ালে প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে একজন জন্মগ্রহণ করে জন্মবধির হয়ে জেনেটিক কারণে শিশুর ককলিয়া তৈরী হয় না। বিশেষ করে নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হলে এই সমস্যা দেখা দেবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাছাড়া গর্ভকালীন সময়ে মা যদি রুবেলা, হাম, মামপস বা এই জাতীয় ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় বিশেষ করে গর্ভের প্রথম তিন মাসের মধ্যে, তবে ককলিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। প্রসবকালীন সময় যদি লম্বা হয়, জন্মের পর যদি বাচ্চার অক্সিজেন কমে যায়, যদি খিচুনী হয় বা মোনজাইটিস হয় তাহলে ককলিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছোট শিশুদের মারাত্মক ডায়রিয়া শিশুকে বধির করে দিতে পারে। এসব প্রতিরোধযোগ্য। নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে না দেয়া, সময়মত মা শিশুকে ক্ষতিকর ভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা দেয়া, জ্বর হলে জ্বরকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, ডায়রিয়ার সঠিক চিকিৎসা করা ইত্যাদি বিষয়ে সতর্ক থাকলে এই শিশু বধিরতা কমে আসবে
অন্যরা কেন বধির হয়ঃ সাধারণ ঠান্ডা সর্দি ভাইরাস, রুবেলা, মামপস, হাম ইত্যাদি ভাইরাস ককলিয়া নষ্ট করে দেয় তাছাড়া যদি কোন কারণে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় তখন ককলিয়া অক্সিজেন পায় না এবং এতে করে ককলিয়া মরে যায়। তখন ককলিয়া নষ্ট হয়ে যায় ফলে মানুষ সম্পূর্ণ বধির হয়ে যায়। কোন দুর্ঘটনার জন্যও ককলিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া কোন কারণ ছাড়াই ককলিয়ার হঠাৎ করে অকেজো হয়ে যেতে পারে। যার কোন কারণ মানুষ খুঁজে পায় না। শুধু বুঝতে পারে হঠাৎ করেই কান দুইটি নষ্ট হয়ে গেছে চিরতরে
এই অপারেশনের জন্য কি প্রয়োজনঃ রোগীকে স্বাভাবিক মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে। একটি ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট টিম থাকবে যে টিমের নেতৃত্ব দিবেন একজন দক্ষ নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞ। একজন শিশু বিশেষজ্ঞ, একজন নিউরোলজিস্ট, একজন বধিরদের শিক্ষক, একজন সাইকোলোজিস্ট, একজন স্পীচ থেরাপিস্ট এবং একটি পূর্ণাঙ্গ অডিওলজিক্যাল সেন্টার এবং ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট। ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট আমাদের দেশে সহজলভ্য নয়। এটা খুবই দামী। এমেরিকায় এই সার্জারির ব্যয় হয় ৪৫ হাজার থেকে ১০৫ হাজার ইউএস ডলার, পার্শ্ববর্তী দেশে খরচ ১৫-১৮ লাখ টাকা আর বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে খরচ পড়ে -১২ হাজার ইউএস ডলার অর্থাৎ সাড়ে ছয় থেকে সাড়ে আট লাখ টাকা। এখানে শুধু ইমপ্ল্যান্টের দামটি নেয়া হয় বাকি সব খরচ ফ্রি।
দেশের প্রতিষ্ঠিত নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞগণ এই চিকিৎসাকে সহজলভ্য করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমরা সরকারিভাবে প্রথম মিটফোর্ড হাসপাতালে সফলভাবে এই অপারেশন করেছি। আরো চারজন রোগী অপারেশনের অপেক্ষায় রয়েছেন। এই অপারেশনের মাধ্যমে শ্রুতিপ্রতিবন্ধীরা হয়ে উঠবে সরব, কর্মক্ষম। বাইপাস সার্জারির মত ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জারিও একদিন সহজলভ্য হবে, বধিরতার চিকিৎসায় নবদিগন্তের সূচনা করবে

0 comments: