সঙ্গীত

“শুনেছি আপনার দেশের মানুষ আপনার কবিতাগুলো সঙ্গীত হিসাবে গায়, আবার স্তোত্র হিসাবেও পাঠ করে?” রবিবাবুর কাছে জানতে চাই। “আপনি ঠিকই শুনেছেন,” বলেন রবি। “আমার দেশের মানুষ কাব্যপ্রেমী। আমার এলাকায় এমন অনেক মানুষ আছেন সারাদিন মাঠে কাজ করবার পর যাঁরা রাতে তারাভরা আকাশের নিচে কোনো এক কুটিরের সামনে বসে গান ধরেন। মধ্যরাত পেরিয়ে চলতে থাকে সেসব আসর। ঈশ্বর ভজনার সঙ্গীত এগুলো—বাংলা গীতিকবিতা সম্পদের শ্রেষ্ঠ অংশে তাদের স্থান।”

“মানুষ যদি আপনার কবিতা সঙ্গীত হিসাবে গেয়ে থাকে তবে কি এগুলো লোককবিতার মতো করে রচিত?”

“আমার কিছু কবিতা লোককবিতার ধাঁচে লেখা,” বললেন ড. ঠাকুর, “তবে আরো কবিতা আছে যেগুলো রোমান্টিক ধাঁচে লেখা, আবার কিছু আছে ধ্রুপদী আঙ্গিকে রচিত।”

“এসব গানের সুর তো আপনি নিজেই দিয়েছেন?”

“হ্যাঁ।”

“এ নিয়ে কিছু বলবেন?
“এ ব্যাপারে কিছু বলাটা বেশ দুরুহ কারণ এটা একেবারেই আপনাদের পাশ্চাত্যের সঙ্গীতের মতো নয়। আমি যখন প্রথম ইংল্যান্ডে যাই তখন অত্যন্ত নামী এক গায়িকার অনুষ্ঠানে নেওয়া হয়েছিল আমাকে। অপেরায় গাইতেন তিনি। কিন্তু তাঁর গান যখন শুনলাম তখন আমি বুঝতেই পারলাম না মানুষ তাঁর গানে কেন এত মুগ্ধ। আমার কানে তাঁর গান রীতিমতো অদ্ভুত শোনাল, অনুকরণসর্বস্ব বলে মনে হলো। একেবারেই মনে ধরল না আমার। কিন্তু নিজেকেই বললাম আমি, “এতগুলো লোকের কাছে যখন এটা সুন্দর বলে মনে হচ্ছে, এবং মানুষ হিসেবে তাঁরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান—আমার ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করা উচিত।” তারপর আমি পাশ্চাত্যের সঙ্গীতে অভিনিবেশ করলাম আর অবশেষে উপলব্ধি করলাম মুগ্ধ হবার মতো অনেক কিছুই এতে আছে। কিন্তু আপনাদের দেশের মানুষ আমাদের সঙ্গীত অনুধাবনের চেষ্টা করবেন না। তাঁরা যখন ভারতে আসেন তখন ভারতীয় সঙ্গীত তাঁদের তৎক্ষণাত পছন্দ হয় না কিন্তু তারপর একে বোঝবার কোনো চেষ্টাই তাঁরা করেন না…”

এটা আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না যে ভারত ভ্রমণের মতো যথেষ্ট রেস্ত আছে যে মার্কিনীদের তারা কখনও ওখানে গিয়ে বাংলার সঙ্গীত কিম্বা শিল্পকলা সম্পর্কে গভীর অভিনিবেশ সহকারে লম্বা সময় ধরে অধ্যয়ন করবে না। এক্ষেত্রে আমাদের অসহিষ্ণুতা হয়ত পাশ্চাত্যের অতি বাস্তবমুখী জীবন যাপনের চাপ থেকে অথবা আমাদের শ্বাসরোধকারী ব্যস্ততার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। ঠিক কোন কারণে ইংরেজীভাষী সঙ্গীতজ্ঞরা ভারতীয় সঙ্গীত সম্পর্কে আগ্রহী হবেন না তা আমার জানা নেই।

“আপনি যখন কোনো কবিতা লেখেন ও তাতে সুর সংযোজন করেন তখন কবিতা ও সুর কি একইসঙ্গে সৃষ্টি করেন? নাকি সুরটি প্রথমে আসে, পরে তাতে শব্দগুলোকে বসিয়ে নেন? নাকি শব্দগুলো আগে সৃষ্টি হয় যেখানে সুর পরে বসানো হয়?”

“কখনও কবিতা আগে লেখা হয়, তারপরে সুরটা বসানো হয়। মাঝে মাঝে সুরটা আগে তৈরি হয়ে যায়, তারপর তাতে শব্দগুলো গাঁথা হয়। আর গানটাতে কখনও শব্দের ভূমিকা সুরের চেয়ে বেশি হয়, কখনও শব্দ গৌণ হয় আর সুর হয়ে যায় মুখ্য।”

“এই যে পদ্ধতি—এটা আপনার ছন্দকে কীভাবে প্রভাবিত করে?”

“এরা সবসময় বদলাতে থাকে। যখনই নতুন কিছু যোগ হয় তাতে আগেরটা বদলে যায়। অনেকটা রেখায় আঁকা ছবিতে রঙ চাপানোর মতো। আপনি যখন শব্দে সুর দেবেন ছন্দটা তখন বদলে যাবে।”

“কিন্তু আবেগের চাবিটিকে তো আপনি বদলে যেতে দেন না—যে সুরটি প্রেমের সেটি সবসময় প্রেমেরই থাকে, কিম্বা কোনো মৃত বন্ধুর স্মরণে যার সৃষ্টি নতুন উপাদান যোগ হওয়ার পরও তো তা বেদনা ভারাক্রান্তই থাকে।”

ড. ঠাকুর তৎক্ষণাত একমত হলেন।

“নতুন যে জিনিসটি যোগ হলো তা তো বাইরের কিছু না,” বললেন তিনি।

“এমনটা কি তাহলে আপনারও মনে হয় যে, কবিতা হোক কি সঙ্গীত, ছন্দের একটা তাৎপর্য থাকেই—যেটা যে ভাব বা আবেগটিকে কবিতা বা সঙ্গীতে প্রকাশ করা হচ্ছে তার সঙ্গে একই তারে বাঁধা?”

ড. ঠাকুর এর উত্তরে জানালেন যে, তিনি মনে করেন ব্যাপারটি এরকমই না হলে ছন্দের কোনো মূল্য আর থাকে না।

“আপনার দেশের কবিরা কোথায় তাঁদের ছন্দ খুঁজে পান? তাঁরা কি অলঙ্কারের মধ্যে থেকে ছন্দ বের করে আনেন?”

তিনি নম্রভাবে হাসলেন, মাথা নাড়লেন।

“আমার আগে তাঁরা অলঙ্কারের পেছনেই ছুটতেন। আমি তাঁদের মুক্তি দিয়েছি।” বলেন তিনি।

“আপনার নিজের ছন্দ কোথা থেকে আসে?”

“অবচেতন থেকে,” বলেন তিনি। “মাটির বুক থেকে ঝর্নার উৎসারণের মতো।”

“আপনার ভাষায় যে ছন্দগুলো আছে সে সম্বন্ধে আমাদের কিছু বলুন!”

“অনেক ধরনের ছন্দ আছে আমাদের—ছন্দের বিরাট বৈচিত্র্য। আমাদের ভাষায় শব্দগুলোর আলাদা করে কোনো বৈশিষ্ট্য নেই, আলাদা করে খেয়াল করবার মতো কোনো উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য তাদের নেই, যেমনটা আছে ইংরেজী শব্দে। এদিক থেকে আমাদের ভাষা ফরাসী ভাষার কাছাকাছি। আমাদের ভাষায় এমন অনেক ছন্দ-পর্ব রয়েছে যেগুলো ইংরেজী ভাষায় একেবারে অসম্ভব। আমাদের আছে চার-স্বর পর্ব, এমনকি পাঁচ-স্বর পর্বও আছে।”

“পদ্যের ছন্দোচ্চারণটা কোথায় আসছে তাহলে?”

“প্রথম স্বরে সাধারণত। এটা অনেকটা নিঃশ্বাস বায়ু ধীরে মিলিয়ে যাবার মতো। একটি ছন্দের একটি পর্ব এরকম—শুরুতে পূর্ণশ্বাস গ্রহণ, এরপর পরবর্তী পর্বের শুরুতে আবার শ্বাস গ্রহণ।”

ড. ঠাকুর এরপর চার-স্বর বিশিষ্ট পর্বে লেখা তাঁর একটি কবিতার কয়েকটি চরণ আবৃত্তি করে শোনালেন। কবিতাটিতে ছন্দের অনুভবটি বড় সুন্দর। আবৃত্তির সময় লক্ষ করলাম তাঁর আঙুলগুলো প্রতি চরণশেষে বিরতির সময়টুকু মেপে টেবিলে তাল ঠুকছে। অর্থাৎ বাংলার কবিদের কাছে সময় শুধু শব্দোচ্চারণের সময় না, নৈঃশব্দের সময়ও বটে। আমাদের আলাপ শেষ করতে হলো। মৃদু দোদুল্যমান ছন্দের স্মৃতি নিয়ে আমি ফিরে এলাম। “বিলীয়মান নিঃশ্বাসের মতো,” কিন্তু পর্ব থেকে পর্বে, চরণ থেকে চরণে সুস্পষ্টভাবে বিন্যস্ত। যে ভাষা আমার জানা নেই অথচ যার সঙ্গীতময়তা আমার কানে এত স্পষ্ট করে ধরা দিয়েছিল, সাধ হয়েছিল সে ভাষায় কবিতা যেন অবিরাম শুনে যাই। 
 
[মার্গারিট উইলকিনসনকে (Marguerite Wilkinson; 1883—1928) দেয়া ভারতীয় কবিতা সম্পর্কিত এই সাক্ষাৎকারটি প্রথম মুদ্রিত হয় নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত The Touchstone, Vol VII, No. 5, ফেব্রয়ারি ১৯২১ সংখ্যায়। কানাডিয়ান-আমেরিকান কবি মার্গারিট উইলকিনসন কয়েকটি পত্রিকায় সাহিত্য পাতার সম্পাদক ছিলেন।]

0 comments: