প্রতিবন্ধীর সংজ্ঞা

প্রতিবন্ধীর সংজ্ঞা কী? প্রতিবন্ধী বলতে আমরা কাদের বুঝি? এই প্রশ্নের উত্তর তাত্ত্বিকভাবে দেওয়া গেলেও বাস্তবসন্মত যুক্তিনিষ্ঠ কোনো সংজ্ঞা দেওয়া যায় কিনা, সেই ক্ষেত্রে সংশয়ের অবকাশ থেকেই যায়। অভিধানিক অর্থে বা সাধারন বুদ্ধিতে শারীরিকভাবে কোনো অঙ্গহানিজনিত প্রতিকুলতা, অথবা মানসিকভাবে বুদ্ধি বিকাশের কোনো অক্ষমতা প্রতিবন্ধকতার কারন। তাহলে কি অন্ধ, মূক, বধির ব্যক্তিরাই প্রতিবন্ধী? তারাই যদি প্রতিবন্ধী হয়, তাহলে "প্রতিবন্ধীর" বিপরীত শব্দ কী, যার মানদন্ডে আমরা নিজেদের অভিহিত করি? এই প্রশ্নের উত্তর আজও খুজে পাওয়া যায় নি। কারন "প্রতিবন্ধী" শব্দটিই বড়ো ঘোলাটে, বড়োই অস্পষ্ট। প্রতিবন্ধী হিসাবে বিচারের মানদন্ড কী হবে তা নির্নয় করা বড়োই কঠিন।



কোলাজ একঃ 

মহানগরীর জনবহুল রাস্তা, যানবাহন ও জনস্রোতের সমুদ্রের এক কোনে ফুটপাথের ধারে এক অন্ধ, অসহায়, রুগ্ন, জীর্নবসন পরিহিতা বৃদ্ধা কাতর কন্ঠে সামান্য সাহায্য পার্থনা করে চলেছে। কিন্তু তার স্বর বড়ো করুন, সাগরের গর্জন ছাপিয়ে যেতে পারে না। এদিকে স্যুট-বুট-টাই পরিহিত হেড অফিসের বড়বাবু তাড়াহুড়োর মাঝে "ভুল" বশত বৃদ্ধার ডান হাত নির্মম ভাবে পদদলিত করে বাস ধরার জন্য ছুটে যাচ্ছেন। বিকৃত আর্তনাদে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে "ভদ্র" লোক নিজের ভুল বুঝতে পেরে ততোধিক বিকৃত কন্ঠে দৃষ্টিহীন বৃদ্ধার উদ্দ্যেশে একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন--"এই বুড়ি! চোখে দেখতে পাস না? পথ ছেড়ে বসতে পারিস না!" ততক্ষনে বাস চলে এসেছে। একরাশ কালো ধোয়ার মাঝে নিরুত্তর বৃদ্ধার করুন মুখটি ঢাকা পড়ে গেল। 



বৃদ্ধা না হয় অন্ধ, তবে বড়োবাবুর দৃষ্টিশক্তি তো অক্ষত। তাহলে তারই তো উচিত ছিল রুগ্ন বৃদ্ধাকে সাহায্যের হাতটুকু বাড়িয়ে দেওয়া। তাহলে প্রতিবন্ধী কে? ঐ বৃদ্ধা? না বড়োবাবু বা অন্যসকল সদাব্যস্ত ব্যাক্তিগন, যারা সব কিছু দেখতে পেয়েও কিছুই যেন দেখতে পায় না?????? :[ :[ :[ :[ 



কোলাজ দুইঃঃ 

রান্নাঘরের কাজে গিন্নিমা বড়ো ব্যাস্ত। পাশে অনাথ, বোবা কাজের মেয়েটি বাসন ধুতে গিয়ে কাচের গ্লাস ও চায়ের কাপ ভেঙ্গে ফেললো। বেয়াদবিতে অতিষ্ঠ গৃহিনী রেগে আগুন হয়ে চায়ের গরম জল মেয়েটির গায়ে ছুড়ে দিলেন। গালিগালাজের ভোল্টেজ বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে থাকল চড়-চাপটা। অসহায়, ভীত সন্ত্রস্ত, মূক মেয়েটির আর্তনাদ চোখের জল হয়ে ভেসে এল।



এই কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে একটা প্রশ্ন বারবার জেগে ওঠে যে আমাদের মতো তথাকথিত সভ্য ও সুবিধা প্রাপ্ত মানুষরাও কি মানসিক রূপে প্রতিবন্ধী নই? অপরকে দুর্বল বলে একঘরে করে রেখে নিজেদের সুখ সম্ভোগের সীমাস্বর্গে আবদ্ধ রেখে আমরা নিজেদের তথাকথিত "প্রতিবন্ধীদের" বিপরীত সেই শ্রেনী হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চাই। অথচ আমাদের চেনা জগতের আবহে চিহ্নিত প্রতিবন্ধীদেরই সাধারনতত্ত্বের থেকে অসাধারনত্ত্বের স্তরে উন্নীত হওয়ার বহু নিদর্শন খুজে পাই, যেমন, হেলেন কেলার, সুধা চন্দ্রন, মাসুদ-উর-রহমান। তারা যেন "প্রতিবন্ধী" এই কথাটির সংজ্ঞাকেই বদলে দিয়ে ধ্রুপদি সত্যটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, "পঙ্গুং লংঘয়তে গিরিম......" তাই অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা সেই অমর পংত্তিগুলো-- "তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর ওপর রাগ করো/ তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো/ তার বেলা?" -- যেন আমাদেরই নিজস্ব প্রতিবন্ধকতাকে তির্যক ভাবে চোখে আঙ্গুল দিয়ে চিহ্নিত করিয়ে দেয়। 



তাহলে প্রতিবন্ধী কে? এই প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া বড়োই দুঃসাধ্য। কারন আমরা সকলেই কোন না কোন দিক দিয়ে প্রতিবন্ধী। সকলেই আমরা নিজেদের অন্তরের সক্ষম মানুষ টিকে জাগিয়ে তুলতে অক্ষম। :] :] :] :] :] :] 

0 comments: