মূক

প্রতিবন্ধীদের জন্যে আলোর ইশকুল



দুই বছরের ছোট্ট মেয়ে নিপা টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে, হারায় শ্রবণশক্তিও মেয়ের মুখে কথা ফোটাতে মা-বাবা ছুটতে থাকেন স্থানীয় ডাক্তার কবিরাজের কাছে কিন্তু কোনো কাজ হয় না এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য মেয়েকে ঢাকায় নিয়ে আসেন ডাক্তাররা জানান, টাইফয়েডে নিপার দুই কানের পর্দা ফেটে গেছে সে আর কোনো দিন শুনতে পাবে না, মুখে ফুটবে না কথার ফুলঝুরি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন বাবা জহির আলম ঘটনার পর মূক-বধিরদের জন্য কিছু করার চিন্তা থেকেই ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন 'শাহজালাল মূক-বধির প্রতিবন্ধী স্কুল'

সিলেটের শাহি ঈদগাহ এলাকার ভাড়া বাসায় থাকেন জহির আলম। পাঁচ রুমের মধ্যে দুই রুমে স্ত্রী, দুই মেয়ে শিশুপুত্রকে নিয়ে তিনি থাকেন। বাকি রুমগুলো ছেড়ে দিয়েছেন স্কুলের জন্য। দিনে সেখানে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী শিশুদের পড়ানো হয়। বিভিন্ন ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে। বর্তমানে স্কুলে শিক্ষার্থীসংখ্যা ১৩০। এর মধ্যে ৫০ জন ছাত্র ৮০ জন ছাত্রী। পড়াশোনা করানোর দায়িত্ব নিয়েছেন জহির আলমের দুই মেয়ে। ছাড়া নামমাত্র সম্মানীতে শিক্ষকতা করছেন নগরীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের আরো পাঁচ শিক্ষার্থী।

স্কুল গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর জহির আলম ঢাকায় আসেন। বিভিন্ন প্রতিবন্ধী স্কুল ঘুরে ধারণা নেন। ইশারা ভাষা (সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ) রপ্ত করার জন্য নিজেই ভর্তি হন ধানমণ্ডির একটি প্রতিবন্ধী স্কুলে। নিজে শেখার পর স্ত্রী ছোট মেয়েকেও সেখানে ভর্তি করান। বিষয়ে অনেক বইপত্রও জোগাড় করেন। এরপর আশপাশের ছয় প্রতিবন্ধী শিশুকে নিয়ে শুরু করেন 'শাহজালাল মূক-বধির প্রতিবন্ধী স্কুল' এর পাশাপাশি সুনামগঞ্জের টেংরাটিলা গ্রামের বাড়িতেও গড়ে তুলেছেন 'টেংরাটিলা মূক-বধির সংঘ' নামে আরেকটি স্কুল। সেখানে শিক্ষার্থীসংখ্যা ৯২। এর মধ্যে আবাসিক সুবিধা পাচ্ছে ছয় শিক্ষার্থী।

স্কুল প্রতিষ্ঠার পর তিনি স্থানীয় প্রভাবশালীদের বাধার মুখে পড়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে স্কুলে আসতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। স্কুলটি পার করেছে ১৫ বছর। দীর্ঘ এই সময়ে অনেক চড়াই-উতরাই পার হতে হয়েছে। কিন্তু কখনো কাজ থেকে দূরে সরে আসার কথা চিন্তাও করতে পারেননি।

সকালবেলা অভিভাবকরা তাঁদের সুস্থ সন্তানদের স্কুল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সেটা চিন্তা করে স্কুলের পাঠদানের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে বিকেলবেলা। প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত চলে স্কুলের কার্যক্রম। জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসরণ করা হয় এখানে। কারিগরি শিক্ষার মধ্যে রয়েছে সেলাই প্রশিক্ষণ, গাড়ির পেইন্টিং, ড্রাইভিং ইত্যাদি। অনেক অসহায় প্রতিবন্ধী হয়ে উঠেছে স্বাবলম্বী। বিনোদনের হিসেবে ক্যারম, ব্যাডমিন্টন, লুডু খেলার সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা।

১৩ বছর বয়সী মূক-বধির মেয়ে আঁখি পুরকায়স্থকে নিয়ে প্রতিদিন আসেন শুভ্রা ধর। তিনি বলছিলেন, 'জন্মের পর থেকেই আঁখি কথা বলতে পারে না, কানেও শোনে না। স্কুলগুলো প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের ভর্তি করাতে চায় না। স্কুলে পড়ে আমার মেয়ে এখন লিখতে পারছে। আমার সুস্থ মেয়েকে সকালে স্কুলে নিয়ে যেতে অনেক ঝামেলা করতে হয়। কিন্তু আঁখিকে স্কুলের কথা বললেই দ্রুত তৈরি হয়ে যায়।'

আট বছরের কাকলীকে নিয়ে প্রতিদিন আসেন তার বাবা সঞ্জিত চন্দ্র রায়। তাঁর মেয়ে এখানে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'অনেক জায়গায় ঘুরেছি মেয়েকে নিয়ে। টাকার বিনিময়েও ভর্তি করাতে রাজি হয়নি। অবশেষে ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। এখানে কোনো টাকা-পয়সা লাগে না। বরং বাচ্চা একদিন না এলে জহির আলম ফোনে খোঁজ নেন।'
স্কুল থেকে অল্প দূরত্বে জহির আলমের মোটর ড্রাইভিং স্কুল আছে। তিনি নিজে সেখানকার প্রশিক্ষক। স্ত্রী আম্বিয়া বেগমও এখানে কাজ করেন মহিলা ড্রাইভিং প্রশিক্ষক হিসেবে। স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে সারা মাসে যা আয় করেন, তার বড় অংশই খরচ করেন স্কুলের পেছনে। বাসা ভাড়া, শিক্ষকদের বেতন, স্কুলের আনুষঙ্গিক খরচের পর হাতে আর অবশিষ্ট কিছু থাকে না। প্রতিমাসে স্কুলের পেছনে কী পরিমাণ খরচ হয় জানতে চাইলে জহির আলম বললেন, 'কখনো হিসাব করে দেখিনি। এতে যদি টাকার প্রতি মায়া চলে আসে।'

যখন স্কুল গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন কয়েকজন এগিয়ে এসেছিলেন। যোগাযোগও রাখছিলেন নিয়মিত। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো ফি নেওয়া হবে না জানতে পেরে তাঁরা সটকে পড়লেন। এরপর প্রতিষ্ঠানের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে প্রতিষ্ঠানটির ওপর নজর পড়ল স্থানীয় এনজিওগুলোর। 

এগিয়ে এল বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে। তাদের ব্যানারে কাজ করলে স্কুলের উন্নতি হবে, পাশাপাশি জহিরের আর্থিক টানাপড়েনও থাকবে না! টাকার কাছে হেরে যেতে রাজি হননি জহির। তিনি তাদের না করে দিলেন।

জহির আলমকে ২০০৮ সালে ইউনিলিভার-এটিএন বাংলা 'সাদা মনের মানুষ' সম্মাননা দেয়। পরের বছর বাংলাভিশন তাঁকে মনোনীত করে 'দিনবদলের মানুষ' হিসেবে।

এসব স্বীকৃতি পেয়ে যেমন আনন্দিত জহির আলম, তেমনি খানিকটা বিব্রতও। বললেন, "এসব স্বীকৃতির জন্য আমার স্কুলের পরিচিতি বেড়ে গেছে। এখন সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকেও অভিভাবকরা তাঁদের মূক-বধির সন্তানদের নিয়ে আসেন এখানে। কিন্তু আমার ক্ষমতা খুব সীমিত। মাত্র তিন রুমের স্কুলে এতজনকে কিভাবে জায়গা দেব? আশা নিয়ে ছুটে আসা মানুষগুলোকে 'না' বলতে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু কী করব?"

স্কুল নিয়ে তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে বলেন, 'আমার অনেক স্বপ্ন এই স্কুলকে নিয়ে। এটিকে একটি ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করতে চাই; যেখানে প্রতিবন্ধীরা কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ আত্বনির্ভরশীল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।'

জহির আলম জানেন, কাজ তাঁর একার পক্ষে করা অনেক কঠিন। বলছিলেন, 'সরকারের কাছে কোনো আর্থিক সহযোগিতা চাইনি কোনো দিন। এখনো চাইছি না। কিন্তু সরকার যদি ধরনের একটি ইনস্টিটিউটের কাঠামো দাঁড় করাতে সহযোগিতা করে এবং এখানে যাঁরা শিক্ষকতা করেন তাঁদের বেতনের স্থায়ী ব্যবস্থা করে দেয়, তবে অসহায় মানুষগুলো উপকৃত হবে।'

যে মেয়ের জন্য জহির আলম এই পথে এসেছেন, সেই নিপাও এখন সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে ক্লাস নিচ্ছেন। তাঁর মধ্যে এখন আর হতাশার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং তাঁর অফুরান প্রাণশক্তি মূক বধির শিক্ষার্থীদের নতুন করে জেগে ওঠার স্বপ্ন দেখায়। 

জহির আলমের আরেক মেয়ে খাদিজা আলম সনি এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই তিনি বাবার মহতী কাজের সঙ্গী। নিজের পড়ার ফাঁকে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে পড়ান। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে জহির আলম তাঁর উপার্জনের সব টাকাই খরচ করেন স্কুলের পেছনে। তাই ঈদের সময়ও কেনা হয়ে ওঠে না নতুন পোশাক। তাতে কোনো আফসোস সেই সনির। বরং বাবার এমন কাজে গর্ব বোধ করেন। বললেন, 'আমার বাবার মতো যদি দেশের সব বাবা এভাবে চিন্তা করতেন, তবে পুরো দেশটাই বদলে যেত।'


মূক

মূক [ mūka ] বিণ.
১. বাকশক্তিহীন, বোবা (‘মুক মুখে দিতে হবে ভাষা’: রবীন্দ্র);
২. বিমুঢ়, হতবাক (বিস্ময়ে মুক হওয়া)
[সং. √ মূ + ক]।


0 comments: